প্রভাবশালী দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লির নৈশভোজগুলোর একটি আলোচ্য বিষয়: শেখ হাসিনা কোথায়? ভারতে হাসিনা রয়েছেন এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তারপরও বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে হেরফের আছে। তবে ভারতের একটি শিক্ষিত শ্রেণীর সদস্যরা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত শক্তিশালী এই নারীনেত্রী ভারত সরকারের একটি নিরাপদ আবাসে (সেফ হাউজ) আছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লিভিত্তিক আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব নেয়া মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সাথে থাকছেন, অথবা তাকে তার সঙ্গীদের সাথে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির অন্যতম সেরা পার্ক লোধি গার্ডেনে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার নিশ্চিত করে আসছে যে, হাসিনা ভারতেই আছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তারা অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তবে বিষয়টি নিয়ে খোদ ভারতেই মানুষের আলোচনা থেমে নেই। হাসিনার দল আওয়ামী লীগ যখন বাংলাদেশের ক্ষমতায়, তখন তার প্রধান বিদেশী সমর্থক ছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। কিন্তু তার অবস্থানের বিষয়ে মোদি সরকার নীরবতা বজায় রেখে চলছে।
দিল্লির দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই এমন ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছে যে, তারা হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার প্রথম সাক্ষাৎকারটি পাবে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। হাসিনার পতনের পর ক্ষমতা গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনকালে শত শত হত্যার জন্য হাসিনাকে দায়ী করে আসছে ।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। ২০১৩ সালে হাসিনার সরকারই চুক্তিটি করেছিল। তত্ত্বগতভাবে এই চুক্তিকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি বাংলাদেশের নতুন সরকার তাকে গ্রেফতার করতে চায়। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ভারতের সাথে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, আমরা তাকে (হাসিনা) বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণের দাবি জানাতে পারি।
আসিফ নজরুল আরো বলেছেন, আপাতত আমরা আশা করি, ভারত তাকে (হাসিনা) বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে দেবে না। তিনি মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়িয়ে এমনটা করার চেষ্টা করছেন।
হাসিনার উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করা বিতর্কিত মন্তব্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের পর ইউনূস নিজেই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তাকে ফেরত না চাওয়া পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতে চায়, তাহলে শর্ত হবে, তাকে চুপ থাকতে হবে।’ নিজ দেশ থেকে পালানো আঞ্চলিক নেতাদের আশ্রয় দেয়ার ইতিহাস রয়েছে ভারতের। চীনা অভিযানের মুখে ১৯৫৯ সালে পালিয়ে ভারতে এসে থাকতে শুরু করেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা।
দালাই লামা ভারতভিত্তিক তিব্বতের নির্বাসিত বেসামরিক প্রশাসনের কাছে রাজনৈতিক দায়িত্বগুলো হস্তান্তর করেছেন। তবে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান। এই পদক্ষেপ বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোদি সরকারের সম্মতি ছাড়া এমনটা হয়নি।
আফগান নেতা মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর পরিবার ১৯৯২ সালে ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে তার স্ত্রী ফাতানা নাজিব ও সন্তানেরা এখনো বেশির ভাগ সময় কাটান বলে জানা যায়। (তারা জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে থাকছেন। নাজিবুল্লাহ পালানো থেকে বিরত ছিলেন। তিনি কয়েক বছর ধরে তার দেশে জাতিসঙ্ঘের একটি কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুলে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে। তার লাশ একটি ট্রাফিক লাইটের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখে।)
১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এর পর শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা বেশ কয়েক বছর ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ভারতের মনমোহন সিং সরকারের পররাষ্ট্র সচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন শিবশঙ্কর মেনন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে নেতাদের ভারতে আসার অনেক নজির আছে। আমরা সব সময় তাদের থাকার অনুমতি দিয়েছি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা আমাদের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থেকেছেন।
ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাসিনার ব্যাপক সমর্থন আছে। ভারতে তাকে ইসলামপন্থী চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি প্রাচীর হিসেবে দেখা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার প্রয়াত পিতার অগ্রণী ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে ভারতে স্মরণ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল ভারতের তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকার। এ জন্য ভারতকে বড় মানবিক মূল্য দিতে হয়।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইউনূসের অধিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হলো ‘রঙিন বিপ্লব’ বা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন, যে দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। মোদিপন্থী লোকজনের বাইরেও ভারতে এই ধারণা প্রবল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতে হাসিনার অবস্থানের যে সংবেদনশীলতা, তার অর্থ হলো, সতর্কতার একটি চাদর আপাতত তার অবস্থানকে ঘিরে থাকতে পারে এবং এসংক্রান্ত পরিকল্পনা নয়াদিল্লিরই করা।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন বলেন, এগুলো ঘনিষ্ঠতার সমস্যা। আর যখন আমাদের প্রতিবেশীদের প্রসঙ্গ আসে, তখন বিষয়গুলো সংবেদনশীল হয়। আমরা বিশ্বের অন্য প্রান্তের দেশগুলোর সাথে যেভাবে কাজ করি, এটা তেমন নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন