১। বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাদেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (Bicameral Parliament) গঠনের কথা উঠছে। দাবিটি যৌক্তিক। বর্তমান কাঠামোতে জাতীয় সংসদ সরকারের জবাদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে না। আইন প্রণয়নেও সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বিদ্যমান অবস্থায় ভালো মানের এমপিও উঠে আসছে না। আনুপাতিকহারে প্রাপ্ত ভোটের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দলের ও নিরপেক্ষ বিভিন্ন পেশার দক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত সদস্যদের নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে বর্তমান সংসদীয় অবস্থার গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠলেও বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা এতদিন ছিল না বললেই চলে। তবে দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের অঙ্গীকার আসার পর এটি বাস্তবে রূপ লাভ করার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তবে বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এটি করা অসম্ভব। সাধারণত: বিশ্বে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী বাংলাদেশ হচ্ছে একটি Unitary State (একক রাষ্ট্র)। এই Unitary State’কে প্রজাতন্ত্রের অন্যতম basic structure হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় রায় দিয়ে বলেছেন যে, সংবিধানের basic structure গুলোকে কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। তবে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সত্যিই এক সুযোগ এসেছে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের। সংবিধান নিয়ে যেহেতু বড় ধরনের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে সেহেতু এই পেক্ষাপটে সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারে। এতে সব অংশীজনেরা সায় দেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
২। বৃটেন, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন অনেক বাংলাদেশি দ্বৈত-নাগরিক। অনেকে বাস্তব ও প্রায়োগিক সুবিধার্থে দ্বৈত-নাগরিকত্ব নিলেও তাদের জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব কেউ কেড়ে নিতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকরা সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিকরা বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, এমনকি প্রধান বিচারপতি হতে পারলেও এমপি হওয়ার পথে সাংবিধানিক বাধা ও বৈষম্য রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে দ্বৈত নাগরিকরা বৃটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার হতে পারেন। শুধু তাই নয় বৃটেনে এমপি হবার জন্য বৃটিশ নাগরিক হওয়ারও বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েও বৃটেনে সেটেল্ড যে কেউ বৃটিশ এমপি হতে পারবেন, এমনকি বৃহৎ দলের নেতা হলে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। সুতরাং জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক যারা দ্বৈত-নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদের জন্য সংবিধানের বৈষম্যমূলক ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা দরকার।
অপরদিকে দেড় কোটির উপরে প্রবাসী অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছেন। তারা বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। চার লক্ষ চাকমা উপজাতির জন্য প্রতিটি সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারেও আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে দেড় কোটি প্রবাসীদের জন্য কোনো সরকারেই প্রবাসী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই দেড় কোটি উপরে প্রবাসীদের মধ্য থেকে ১০% সংসদে ও সরকারে প্রতিনিধিত্বের জন্য পরিস্কার সাংবিধানিক প্রভিশন রাখার সুপারিশ করা যেতে পারে। এমন ধারণা পৃথিবীতে নতুন নয়। ফ্রান্স ও তুরস্কসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে।
৩। তিনটি বিভাগ নিয়ে অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত। আর সেগুলো হলো: আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচারবিভাগ। দু:খজনক ও আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের জন্য স্ব স্ব সচিবালয় থাকলেও বিচারবিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় নেই। অতীতের কোনো সরকারই করেনি বা করতে দেয়নি। বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে, “রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন৷” স্বতন্ত্র ও পৃথক বিভাগ হিসাবে গড়ে উঠার জন্য বিচারবিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় অতি জরুরি। তাছাড়া বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সর্বোপরি নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচারবিভাগকে রক্ষার জন্য বিচারবিভাগের আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে হাইকোর্ট বিভাগের। এটি সুচারুরূপে নিশ্চিত করতেও পূর্নাঙ্গ (full fledged) সচিবালয় দরকার। তাই সংবিধানের ৭৯ অনুচ্ছেদে যেভাবে সংসদের নিজস্ব সচিবালয় থাকার কথা বলা হয়েছে ঠিক অনুরূপভাবে বিচারবিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয়ের জন্য পৃথক অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ যাতে কোনো রাজনৈতিক সরকার অবজ্ঞা করতে না পারে।
৪। সংবিধানে সরকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের কথা বিস্তারিতভাবে বলা আছে। কিন্তু বিরোধী দলের নেতার কথা নেই, নেই ছায়া মন্ত্রিসভার (শ্যাডো ক্যাবিনেট) কথা। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল ও বিরোধী দল হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ - অনেকটা দ্বি-চক্র যানের মতো যার একটি চাকা বিকল হলে খোদ যানটিই চলতে পারে না, হয়ে যায় বিকল। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে বিরোধী দলের নেতার অবস্থান আছে। Warrant of Precedence, 1986 (revised up to July 2020) অনুযায়ী বিরোধী দলের নেতার অবস্থানের ও মর্যাদার ক্রমিক হচ্ছে ৫। তাঁর এই অবস্থান ক্যাবিনেট মিনিস্টার, চিফ হুইপ ও ডেপুটি স্পিকারের মর্যাদার। গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে প্রধান বিরোধী দল, বিরোধী দলের নেতা ও শ্যাডো ক্যাবিনেটকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তাদের অবস্থান, তাদেরকে নিয়ে গড়ে উঠা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ সংবিধানের অংশ।
৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত নতুন সংবিধানে প্রধান বিরোধী দল, বিরোধী দলের নেতা ও শ্যাডো ক্যাবিনেটের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান সন্নিবেশিত করা উচিৎ। এতে গণতন্ত্র সুদৃঢ় হবে, নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে ও সংসদীয় গণতন্ত্রের ভারসাম্য এবং ঐতিহ্য বজায় থাকবে।
৫। সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে লিখে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে পতিত সরকার বা তাদের কোনো দোসর যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে বর্তমান সরকারের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে। সর্বোচ্চ দণ্ড মানে বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড। উক্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত মূল শব্দগুলো (Key words)দেখুন: শক্তি প্রদর্শন, শক্তি প্রয়োগ, ষড়যন্ত্র, অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে, উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এই ওয়ার্ডগুলো অতি সহজে misinterpreted হতে পারে, হতে বাধ্য। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মতলবি ব্যাখ্যাও দিতে পারে। অথচ এগুলোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা যাবে। দুনিয়ার সাংবিধানিক ইতিহাসে এমন ঢিলেঢালা শব্দের (loosely worded) প্রভিশন দিয়ে capital punishment নিশ্চিত করা বিরল। তাছাড়া সংবিধান কোনো দণ্ডবিধি নয় যে, এখানে এভাবে শাস্তির কথা থাকবে বরং এটি রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যকর দলিল।
অপরদিকে সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সিংহভাগ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এক সংসদ কি ভবিষ্যৎ সকল সংসদের হাত এভাবে বাঁধতে পারে? এমন নজির পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সংবিধান হচ্ছে চলমান (Continuous) ও কার্যকর (Operative) ডকুমেন্ট। সময়ের প্রয়োজনে এটা সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ করার অধিকার সংসদের থাকা উচিৎ। বড়জোর কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য গণভোটের শর্ত রাখা যেতে পারে। এই-ই। কোনোভাবেই এক সংসদ ভবিষ্যৎ সব সংসদের হাত বাধঁতে পারে না। তাই সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি বিলুপ্ত করা দরকার।
৬। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো এমপি তার নিজের রাজনৈতিক দল হতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদান করলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। এ ধারা অত্যন্ত অযৌক্তিক, বিবেক বিরোধী ও সংসদ সদস্যদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। এটার মাধ্যমে এমপিদের মুখে ও বিবেকে লাগাম টেনে ধরা হয়। এটা জনগণের মেন্ডেটের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর নামান্তর। কোনো অন্যায় ও অযৌক্তিক প্রস্তাব বা বিল সংসদে আসলে এবং বিবেক থেকে সেটির বিরুদ্ধে কোনো এমপি ভোট দিলে তার এমপি পদ শূন্য হবে কেন? এ ধরনের কঠোর (Draconian) ও অযৌক্তিক প্রভিশন গণতন্ত্রের সুতিকাগার বৃটেনে নেই। বৃটেনে দল নমিনেশন দিলেও, এমপি নির্বাচিত হোন সংশ্লিষ্ট প্রার্থী তার ব্যক্তিগত ক্রেডিন্সিয়ালের ভিত্তিতে। এমপি নির্বাচিত হবার পর মূলত: তিনি ও তার ভোটারদের মধ্যে এক সামাজিক চুক্তি (Social contract) হয়। তাই এমপি’র পদ শূন্য হবে হয় নিজ থেকে তিনি পদত্যাগ করলে বা ভোটাররা সঠিকভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনাস্থা আনলে অথবা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে।
বৃটেনে কোনো এমপি দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সাধারণত: দলের হুইপ উইথড্রো করা হয়, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এমপি দলের না হয়ে বরং হয়ে পড়েন স্বতন্ত্র এমপি। দল থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর দল থেকে পদত্যাগ করলেও স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে থাকা যায়। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট এমপি নিজে এমপি থেকে ইচ্ছকৃতভাবে পদত্যাগ করলে বা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে কেবল তার এমপি পদ শূন্য হবে। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো এমন অযৌক্তিক, বিবেক বিরোধী ও সংসদ সদস্যদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি এই কালো অনুচ্ছেদ হয় বিলুপ্ত করা দরকার নতুবা কমপক্ষে শর্ত শিতিল করে এমন পর্যায়ে আনা দরকার যে সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে এমপিরা নিজের বিবেক থেকে ভোট দিতে পারবেন।
৭। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোকে বলবৎ করতে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সংবিধান হচ্ছে অপারেটিভ ডকুমেন্ট, এতে মতবাদ বা মতাদর্শ রাখা ঠিক না। মতবাদ বা মতাদর্শ সংবিধানে থাকলে সংবিধান নিয়ে টেনশন, বাগাড়ম্বর ও ঘনঘন পরিবর্তনের টেন্ডেন্সি কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। গত ৫২ বছরের ইতিহাস তো তাই বলে। গণতন্ত্র শক্ত, সুন্দর ও সঠিকভাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত থাকবে এবং রাখা অত্যাবশ্যক। বাকি সব রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্ব স্ব মতবাদ বা মতাদর্শ অনুসারে ভোটারদের মন জয় করতে কাজ ও প্রচারণা চালিয়ে যাবে। জনগণের সঠিক ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে তারা তাদের মতবাদ বা মতাদর্শ দিয়ে দেশ চালাবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পর জনগণের ভালো লাগলে সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্র অনুয়াযী আবার ক্ষমতায় পাঠাবে অথবা তাদের পরিবর্তন করে অন্য বিকল্প দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে।
কোন ই্জম তথা মতবাদ বা মতাদর্শ সংবিধানে রাখা উচিৎ নয় বলে সেই ২০১১ সালে গঠিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সাব-কমিটিতে মত দিয়েছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও মেধাবী জুরিস্ট ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল। লন্ডনে আমার সাথে আলাপে তাঁর কথা ছিল এমন “isms – such as socialism, capitalism, communism – should never be in the constitution. If these were in the constitution, political tension, deadlock and unnecessary debates would never end. [The] constitution is an operative document and democracy and democracy alone should be in it. Whichever party comes to office, with a mandate from the people, will run the country in accordance with its political ideology or ism” (অর্থাৎ “মতবাদ তথা সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদের মতবাদ – কখনোই সংবিধানে থাকা উচিত নয়। এগুলো সংবিধানে থাকলে রাজনৈতিক উত্তেজনা, অচলাবস্থা ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের অবসান হবে না। সংবিধান একটি কার্যকরী দলিল এবং গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র একাই এতে থাকা উচিত। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা মতবাদ অনুযায়ী দেশ চালাবে।”
ঠিক এই কথা বলে গেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইয়ের ৬১৯ পৃষ্টায়। তিনি বলেন: “ডিমক্রেসি, সোশিয়ালিযম, ন্যাশনালিজম ও সেকিউলারিজম: এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। ……..কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনওটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লেখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া বাকী সবকটিই সরকারী নীতি - রাষ্ট্রীয় নীতি নয়।……..এই কারণে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করিয়া আর- আর বিষয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মঙ্গল।……সে জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শুধু নিরংকুশ গণতন্ত্রের নিশ্ছিদ্র বিধান করিয়া বাকী সব ভাল কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ পার্লামেন্টের রচিত আইনের দ্বারা তা না করিয়া আইনের বিষয়বস্তুসমুহ সংবিধানে ঢুকাইলে সংবিধানের স্থায়িত্ব, পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তা আর থাকে না। নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হইবেন, সেই দলই তাদের পছন্দমত সংবিধান সংশোধন করিয়া লইবেন, এমন হইলে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের আর কোন দাম থাকে না”।
৮। আরো কিছু বিষয় সংবিধান সংস্কার কমিশন আমলে নিতে পারেন। প্রথমত: ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা যাবে যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন এবং এক সাথে ৩০০+৩০০ মোট ৬০০ এমপি স্বল্পসময়ের জন্য হলেও নির্বাচিত থাকেন একসাথে! এই বিধানের প্র্যাকটিস পতিত সরকার করেছেনও। এমন হাস্যকর বিধান বাতিল করা দরকার। দ্বিতীয়ত: ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত হন তাহলে কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন এই বিষয়টি সংবিধান অনুধাবন (contemplate) করেনি। এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট ও inclusive বিধান থাকা দরকার। তৃতীয়ত: ১৯৭২ সাল থেকে গত ৫২ বছরে পৃথিবী ও বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছি। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে অনেক অধিকার অনুধাবন করা হয়নি যা এখন বাস্তব, যেমন তথ্য পাবার স্বাধীনতার অধিকার, ইন্টারনেট সেবা পাবার অধিকার ইত্যাদি। সুতরাং সংবিধানের মৌলিক অধিকার সম্বলিত সংবিধানের তৃতীয় ভাগকে ব্যাপক রিভিউ করে এতে আধুনিক মৌলিক অধিকারগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ। চতুর্থত: ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে যা সরাসরি তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। সংবিধানের মধ্যে এ ধরনের বিপরীতমুখিতা ও সাংঘর্ষিকতা দূর করা দরকার।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: [email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন