দুর্নীতি প্রতিরোধে দেশের একমাত্র সংবিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও কার্যত পরাধীন সংস্থাটি। সব আমলেই দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশনের কাজ চলে ক্ষমতার ছায়া অনুসরণ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো কমিশনই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে নজির সৃষ্টি করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের (মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে যতটা নীরব দুদক, ততটাই সরব ক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। মূলত সব কমিশনের কাজ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গর্জে উঠবে দুদক। রাজনৈতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোরভাবে কাজ করবে সংস্থাটি। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। তবে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও পতিত সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে মামলা এবং দেশে-বিদেশে তাদের স্থাবর-অস্থাবর বিপুল সম্পদ জব্দের রেকর্ড করেছে সংস্থাটি। আপাতদৃষ্টিতে এই তৃপ্তি নিয়েই আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করতে যাচ্ছে দুদক। সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় সংস্থাটির সক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিবেচনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, ‘দুদকের দাঁত যতটা শার্প হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। নখও ততটা গজায়নি। মাঝামাঝি একটা পর্যায়ে আছে।’ দুর্নীতি প্রতিরোধ দুদকের একার কাজ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী সরকারের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপির যে সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ছিল, সেগুলো ঢালাওভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে। দুদকের এই পদক্ষেপ এমন বার্তা দিচ্ছে যে-যারা ক্ষমতার বাইরে, দুদক তাদের পেছনে যাবে, আর যারা ক্ষমতার কাছাকাছি বা ক্ষমতায় যারা আসবে, তাদের ক্ষেত্রে ভিন্নচিন্তা করবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের এক বা একাধিক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। দুদক নিজেও সেটা স্বীকার করেছে। সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান-এর বাইরে তেমন কিছু শোনা যায়নি। এটাই প্রমাণ করে দুদক ক্ষমতার ছায়া অনুসরণ করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদকের কার্যক্ষমতা, সক্ষমতা, স্বাধীনতা পুরোপুরি কমিশনের ওপর নির্ভর করে। ওখানে দুদকের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো পুরো কমিশন আমলাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমলাতন্ত্রের প্রভাব দেশের দুর্নীতির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। সেটা অব্যাহত আছে। দুদক কোন বিষয়ে কাজ করবে, সেই সিদ্ধান্তও আমলাতন্ত্রের হাতেই। এ কারণে দুদকের কাজ পক্ষপাতমূলক হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক।
জানা যায়, পতিত সরকারের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে সংস্থাটি ছিল বড় দুর্নীতিবাজদের ‘রক্ষাকবচ’। তখন ‘রাঘববোয়াল’ হিসাবে পরিচিত প্রায় তিন হাজার ব্যক্তিকে দায়মুক্তি বা ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে অনুসন্ধান পর্যায়ে তা নথিভুক্ত করা হয়। আবার অনেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুর্নীতির সত্যতা পাওয়ায় মামলা করা হলেও তদন্তের পর ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু (এফআরটি)-এর মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী অনেকেই তিন-চার দফা দায়মুক্তির সনদ বাগিয়ে বহাল তবিয়তে ছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান ও মামলা হচ্ছে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে ১১ হাজার ৬৩০টি। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৯৬০টি অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এ সময়ের মধ্যে মোট মামলা করা হয়েছে ৫১২টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ১৯১ জনকে। আর তদন্ত শেষে ৪৩৫টি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এফআরটি দেওয়া হয়েছে ৭৩টি মামলার। দেশে ৩ হাজার ৩৫১ কোটি ২৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকার এবং বিদেশে ৯৬ কোটি ৫৩ লাখ ৮০ হাজার ২৫ টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। আর দেশে ২ হাজার ২২২ কোটি টাকার বেশি এবং বিদেশে ২৫১ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ অ্যাকাউন্টে ফ্রিজ করা হয়েছে। গত এক বছরে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা।
এর আগে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে রাঘববোয়ালসহ ২ হাজার ৭৮৮ জন দুর্নীতিবাজ দুদকের জালে ফেঁসেছেন। যারা সরাসরি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিভিন্ন মামলা বা চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৩২ জন মামলার এবং ১ হাজার ৩৫৬ জন চার্জশিটভুক্ত আসামি। এর মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিক এবং ৭১৫ জন বেসরকারি চাকরিজীবীসহ অন্যান্য পেশার ব্যক্তিও রয়েছেন।
এদিকে একজন আইনজীবীর নোটিশ এবং একটি রাজনৈতিক দলের দাবি ও ঘেরাওয়ের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টার পিএস ও পিও এবং নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বিরুদ্ধে দুদক দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে। এখনো তাদের বিরুদ্ধে সংস্থাটির পদক্ষেপ অনুসন্ধান পর্যায়েই আটকে আছে।
আলাপকালে দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রায় একই ধরনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানরা ক্ষুব্ধ হন-এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো কমিশনই নিতে চায় না। কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের ইচ্ছা, আবার কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ প্রভাবের কারণে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজের বৈপরীত্য সংস্থাটিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে দুদক কর্মকর্তারা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে দুই রকম প্রতিবেদন দিচ্ছেন, যা প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর।
জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম (লিগ্যাল) যুগান্তরকে বলেন, ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সব সরকারই সংস্থাটিকে তাদের মতো চালানোর চেষ্টা করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যেভাবে চেয়েছে, দুদক সেভাবেই চলেছে। তখন সরকার কঠোরতা দেখিয়েছিল, দুদকও কঠোরভাবে কাজ করেছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের সঙ্গে যারা সায় দিয়ে চলছেন, তাদের চাওয়ামতোই দুদক কাজ করছে। ফলে এখন শুধু বিগত আওয়ামী রেজিমের লোকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও মামলা হচ্ছে। আবার আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের মতো করে দুদককে ব্যবহার করেছে।
তবে বর্তমান কমিশন দুদকের সাবেক এক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে। বেশ কয়েকজন নিজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুদকের এসব কাজকে সাহসী পদক্ষেপ হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০০৪ সালে গঠিত কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। এরপর যথাক্রমে সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, গোলাম রহমান, মো. বদিউজ্জামান, ইকবাল মাহমুদ ও মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ যুগের অবসান হয়েছে। কিন্তু দুদকের ভাবমূর্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। উলটো সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে বর্তমান কমিশন।
সর্বশেষ গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের যাত্রা শুরু হয়। ৫ আগস্টের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, অনুসন্ধান ও তদন্তে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটিকে।