সাত কলেজকে একীভূত করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ (ডিসিইউ) গঠনের ঘোষণা ছিল রাজধানীর উচ্চশিক্ষা সঙ্কট সমাধানের এক নতুন দুয়ার। কিন্তু ঘোষণার ৯ মাসের মাথায় প্রকল্পটি দাঁড়িয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা, অবিশ্বাস, লুকানো চুক্তি, কর্মকর্তা-শিক্ষক-রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রতিযোগী স্বার্থ এবং প্রশাসনিক নীরবতার এক বিপজ্জনক সীমানায়।
তথ্য বলছে- সাত কলেজের এক লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী, ভর্তিঝুঁকিতে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন ব্যাচ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে তৈরি হওয়া মতবিরোধ- সব কিছু এখন এক ধরনের ছায়া-সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই সঙ্কট আসলে কার তৈরি? কে বা কারা এই দীর্ঘসূত্রতা থেকে লাভবান? আর কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক কমিটি গঠন করেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এড়াচ্ছে? ইউজিসির দায়িত্ববান ব্যক্তিই বা কী করছে?
অধ্যাদেশের ধোঁয়াশা : কারা টেনে ধরছে?
২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খসড়া অধ্যাদেশই মূল সঙ্কটের জন্ম দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে- শিক্ষা ক্যাডারের একটি প্রভাবশালী অংশ, কিছু কলেজের প্রিন্সিপাল, ইউজিসির একটি চক্র এবং উচ্চপর্যায়ের এক শ্রেণীর আমলা অদৃশ্যভাবে এই রূপান্তর আটকে রাখার চেষ্টা করছে।
তাদের আশঙ্কা, বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজগুলোর নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক ক্ষমতা, নিয়োগের সুযোগ এবং কলেজভিত্তিক ‘অনার্স শিল্প’- সবই ধসে পড়বে।
এক শিক্ষা কর্মকর্তার ভাষায় : ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজ-অফিসের দুর্নীতি, নিয়োগ-কমার্স সব বন্ধ হয়ে যাবে। এটা অনেকেই চায় না।’
শিক্ষার্থীরা বলছে, ‘এটা রূপান্তর নয়, আমাদের জীবন নিয়ে খেলা’ : ঢাকার নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট এলাকা এখন নিয়মিত অবরোধের অভিজ্ঞতা পাচ্ছে। স্নাতক শিক্ষার্থীরা বলছে- সাত কলেজকে ‘কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ ঘোষণার পরও, কোথায় হবে ক্যাম্পাস? কে হবেন শিক্ষক? কোন বিভাগ থাকবে আর কোনটি বাদ? ভর্তি কিভাবে হবে? সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা কী হবে? এসব মৌলিক প্রশ্নের কোনোটিরই উত্তর না দিয়ে প্রকল্পটিকে ‘ঘোষণার মধ্যে আটকে রাখা’ হচ্ছে।
এক শিক্ষার্থীর কথায়, ‘আমাদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ কর্মকর্তারা বলছেন ছয় হাজার ইমেইল পড়তে সময় লাগছে!’
শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থান : স্বার্থনির্ভর নাকি যুক্তিনির্ভর : বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার প্রকাশ্যে বলছে-বিশ্ববিদ্যালয় হলে নি¤œবিত্ত শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে, শিক্ষকদের পদ-পদবি ঝুঁকিতে পড়বে, কলেজের ঐতিহ্য হারাবে।
কিন্তু তদন্তে উঠে আসছে- এই আপত্তিগুলো মূলত ‘পদমর্যাদা খোয়ানোর ভয়’ থেকেই তৈরি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষকরা প্রমোশন পাবেন নতুন স্কেলে; নতুন নিয়োগপদ্ধতি চালু হবে এবং পুরনো ক্ষমতা কাঠামো ভেঙে পড়বে।
এক শিক্ষা ক্যাডার সদস্য গোপনে বলেন- ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজে পদ-পদবি দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে।’
তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষ : উচ্চমাধ্যমিক ও মহিলা কলেজের শঙ্কা নাকি কেউ তাদের ব্যবহার করছে?
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ভয় হলো- ঢাকা কলেজসহ পাঁচটি কলেজে এখনো উচ্চমাধ্যমিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে এই বিভাগ বাতিল হতে পারে- এমন শঙ্কায় ছাত্ররা রাস্তায়। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে-কিছু শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থী সংগঠন এদের পেছনে প্রভাব বিস্তার করছে। লক্ষ্য- রূপান্তর থামানো।
মহিলা কলেজগুলোতেও উদ্বেগ রয়েছে। ইডেন ও বদরুন্নেছা কলেজের শিক্ষার্থীদের বলা হচ্ছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলে সহশিক্ষা হবে।’ কিন্তু খসড়ায় এমন কিছু নেই।
এখানেও সন্দেহ- তাদের আন্দোলনকে কেউ সংগঠিত করছে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরকে আরো জটিল করে তোলা যায়।
ভর্তিপ্রক্রিয়ার রহস্যজনক স্থবিরতা- ইচ্ছাকৃত বিলম্ব : ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে- অধ্যাদেশ আসেনি। মতামত বেশি এসেছে।’
কিন্তু সত্য হলো- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- কেউই ভর্তি কমিটি বসাতে পারছে না কারণ মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না।
এটিকে অনেকে বলছেন, ‘ইচ্ছাকৃত প্রশাসনিক ব্ল্যাকআউট।’
এর ফলে সম্ভাবনা রয়েছে, ন্যূনতম ১-২ বছরের সেশনজট, কর্মজীবনে পিছিয়ে পড়া, বিদেশে ভর্তি আটকে যাওয়া, পরিবারগুলোর ওপর আর্থিক চাপ। এমন পরিস্থিতিকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘আমরা রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার।’
রাজপথ : পাল্টাপাল্টি আন্দোলনের নেপথ্যে কারা : দিনের পর দিন রাজপথ গরম। অবস্থান-শিক্ষাভবন। দাবি-অধ্যাদেশ জারি। অন্যদিকে অন্য এক পক্ষ বলছে- ‘বিশ্ববিদ্যালয় বাতিল করো, কলেজ রাখো।’
এই দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কর্মসূচির নেপথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে- কিছু প্রভাবশালী শিক্ষক, কলেজ প্রশাসনের একটি অংশ এবং রাজধানীর রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ‘কাঠামো’- এই সঙ্কটকে টেনে নিচ্ছে আরো জটিলতার দিকে।
প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- ‘সাত কলেজ নিয়ে গোপনে লাভবান এমন একটা গোষ্ঠী আছে। তারা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় চায় না।’
মন্ত্রণালয়ের অবস্থান : নীরবতা নাকি ইচ্ছাকৃত দেরি?
মন্ত্রণালয় বলছে- ‘সময় লাগছে।’ ‘মতামত যাচাই হচ্ছে।’ ‘রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন।’
কিন্তু সূত্র বলছে, অধ্যাদেশের খসড়া বহু আগেই প্রস্তুত। দুইবার সংশোধনও হয়েছে। তবু এটি আটকে আছে উচ্চপর্যায়ের ‘সব পক্ষকে খুশি’ রাখার চাপে।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অধ্যাদেশে স্বাক্ষর মানে শিক্ষকদের, ছাত্রদের, কর্মকর্তাদের তিন দিকের রোষের মুখে পড়া। অনেকেই তাই সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে একের পর এক সঙ্কট। কোনটিরই সহজ সমাধান হচ্ছে না। সবার ইঙ্গিত মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ দায়িত্ববানের দূরদর্শিতা ও সক্ষমতার প্রতি। মন্ত্রী সি আর আবরার ইউজিসিতে তার আস্থাভাজন সদস্য অধ্যাপক তানজিমের কথায় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সব কিছু জটিল করে ফেলছেন- মন্তব্য সংশ্লিষ্ট একজনের।
কেন আলোচনা হচ্ছে না?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অক্সফোর্ড ফেডারেল মডেল’, যুক্তরাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত কাঠামো, ভারতের ক্লাস্টার ইউনিভার্সিটি মডেল- এসবই হতে পারে সমাধান। যেখানে কলেজগুলো নাম, ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হবে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, মন্ত্রণালয় এই মডেলগুলোর কোনোটিই আলোচনায় আনছে না।
কেন? প্রশ্ন রয়ে গেছে। সাত কলেজ জিম্মি-দায় কার?
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নিয়ে চলমান এই ধোঁয়াশা-
- প্রশাসনিক অদক্ষতা,
- স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর তৎপরতা,
- রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব,
- এবং মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতার
এক যৌথ ফল।
আজ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করছে- ‘কারা আমাদের ভবিষ্যৎ জিম্মি করে রেখেছে?’
যদি দ্রুত, স্বচ্ছ, অংশীজননির্ভর, বৈজ্ঞানিক সমাধান না আসে- তবে এই সঙ্কট কেবল সাত কলেজ নয়- ঢাকার পাবলিক উচ্চশিক্ষা কাঠামোকেই এক দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় ঝুঁকিতে ফেলবে।
এখন প্রশ্ন- রাষ্ট্র কি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বাঁচাবে, নাকি নীরব থাকবে?