প্রভাবশালী ও দুর্ধর্ষ বন্দী বেশি থাকায় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই কারাগার কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই কারাগারের নিরাপত্তা ও নজরদারি বেশি থাকার কথা। তবে এখানে বহু বন্দী অবৈধভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করে বাইরের মাদক কারবার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্দেশনাও দেন। এমনকি দুর্ধর্ষ কয়েকজন কারাগার ভেঙে পালানোরও পরিকল্পনা করেছিলেন।
পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছে। কয়েক মাস আগে দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুটি কারাগারে বন্দীরা অবৈধভাবে অন্তত ৩৬০টি মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭৯টি এবং কাশিমপুরে ২৮১টি। কারাগারকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ স্থানে পরিণত করতে কিছু অসাধু কারা সদস্য সহযোগিতা করছেন। এসবি জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দুই কারাগারে নজরদারি চালানো হয়। কারাগারের ভেতর ও পার্শ্ববর্তী বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন থেকে সংগৃহীত ২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫২টি নম্বর বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করা হয় ৩৬০টি অবৈধ নম্বর। অবৈধ ফোন সরবরাহে যুক্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, টাকার বিনিময়ে কেউ কেউ নিয়মিত ফোন রাখেন, অনেকে প্রয়োজনমতো কথা বলেন। কাশিমপুরে বন্দী অবস্থায় এক আসামি তাঁর মামলার বাদীকে হত্যা করার হুমকি দেন। এ ঘটনায় ঢাকায় একটি জিডিও হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আলোচিত অপরাধীদের মুঠোফোনে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও পুরোনো। উগ্রবাদে জড়িত বন্দীদের ফোন ব্যবহারের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারামুক্ত ব্যক্তি বলেন, বিভিন্ন সেলের দায়িত্বে থাকা বন্দী ও কিছু কারারক্ষী টাকার বিনিময়ে ফোন ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। ৫০০ টাকায় ১০-১৫ মিনিট কথা বলা যায়। কখনো পিসি কার্ড থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়, কখনো সিগারেটের প্যাকেটের বিনিময়েও কথা বলা সম্ভব হয়। একটি সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছর কারাগারে থেকেই একজন ব্যবসায়ী ফোনে বাইরের ব্যবসা পরিচালনা করেছেন এবং পছন্দের খাবার খেয়েছেন। এদিকে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, ফোন ব্যবহারের ঘটনা ধরা পড়লেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শরীরে লুকিয়ে খুব ছোট আকারের ফোন ঢুকছে, যা কখনো স্ক্যানারেও ধরা পড়ে না। অসাধু কারারক্ষী ও পুরোনো কিছু বন্দী এতে জড়িত। এসবি বলছে, কিছু কারারক্ষী ফোন ব্যবসায় জড়িত। তারা ফোন ও সিম সরবরাহে সহায়তা করে। প্রতিবেদনে কারাগারে কর্মরত নয়জনের নাম এসেছে। কাশিমপুরের চারটি কারাগারে ৯-১০ হাজার বন্দী এবং কেরানীগঞ্জে ৯ হাজারের বেশি বন্দী আছেন; এর মধ্যে ১৩০ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত।
সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া একজন বলেন, সিগারেট দিলে সব ম্যানেজ হয়। কারারক্ষী, সেলের ইনচার্জ ও ফোন রাইডারের যোগসাজশে এসব চলে। নিয়মিত নিজের কাছে ফোন রাখতে চাইলে বড় অঙ্কের টাকা লাগে। কাশিমপুর কারাগার সূত্র জানায়, জুন-আগস্টে ৯৭টি এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মিলিয়ে ৭০টির বেশি ফোন উদ্ধার হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পায়ুপথে ছোট ফোন ঢোকানো হয়। এক বন্দী একসঙ্গে দুইটি ফোন এনেছিলেন, আরেকজন ফোন বের করতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ হন। বাইরে থেকে মাদক ও ফোন বলের মতো করে ছুড়ে দেওয়ার ঘটনাও পাওয়া গেছে। এসবি বলছে, অসাধু কারারক্ষীরা খাবার, ওষুধ, জুতা ও উপহারের মধ্যে লুকিয়ে ফোন ও সিম সরবরাহ করেন। হাই সিকিউরিটি কারাগারে প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অন্তত ৫০ জন বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। কাশিমপুরের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন জানান, "বডি স্ক্যানার নষ্ট থাকায় ফোন ঢুকেছে, এবং কেউ কেউ সহায়তা করে থাকতে পারেন। অভিযান চালিয়ে ফোন জব্দ ও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।" এসবি অনুসন্ধানে দেখা যায়, বন্দীরা একই ফোন বা সিম বিভিন্ন জনের হাতে ঘুরিয়ে ব্যবহার করেন। শৌচাগার, গোসলখানা বা কাপড়ে ঢেকে চুপিসারে কথা বলেন। মুক্তির আগে অন্য বন্দীর কাছে ফোন দিয়ে যান। কাশিমপুরে কমোডের ভেতরে ফাটলে, ফ্লাশের পাইপে পলিথিনে মুড়িয়ে বা মোজায় বেঁধে জানালার বাইরে ফোন রাখা হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার বলেন, "ভেতরে মোবাইল ব্যবহৃত হয়, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কেউ কেউ জড়িতও থাকতে পারেন। তবে অভিযান চালিয়ে অনেক কমানো হয়েছে। মূল সমস্যা সরবরাহকারীদের শনাক্ত করা।" এসবি জানায়, দুই কারাগারের বন্দীরা কারাগার ভেঙে পলায়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। আটক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। হাই সিকিউরিটিতে তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী জানালা ভেঙে দড়ি বেয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কম্বল ছিঁড়ে দড়ি বানিয়ে শৌচাগারের টাইলস সরিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। বিষয়টি ধরা পড়ায় তারা ব্যর্থ হন, পরে মেঝেতে সিমেন্ট-বালুর প্রলেপ দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের অনেকে ফোনে বাইরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্দেশনা দেন। কারাগার থেকেই সন্ত্রাসী গ্রুপ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের তথ্যও এসেছে। বাইরে অস্ত্র ব্যবহার, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যায় সম্পৃক্ততা এবং মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ঘটনাও প্রতিবেদনে রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কারাগারের দুর্বল নজরদারির কারণে বাইরে আইনশৃঙ্খলায় প্রভাব পড়ে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও মগবাজার–গুলশান–বাড্ডা এলাকায় কিছু ঘটনায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। কারা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবল ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি এবং কারা সদস্যদের দীর্ঘদিনের অনিয়ম পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে। তাই অভ্যন্তরীণ সমস্যাও নিরসন কঠিন।
এসবি কারাগারে জ্যামার আধুনিকায়ন-সম্প্রসারণ, সিসি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ জোরদার, স্ক্যানার উন্নতকরণ এবং তল্লাশি বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। ফোন-সিম সরবরাহকারীদের শনাক্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া, অবৈধ নম্বরগুলোর ওপর নজরদারি এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের ভেটিংয়ের কথাও বলা হয়েছে। কারা মহাপরিদর্শক মোতাহের হোসেন বলেন, এসবি প্রতিবেদন এসেছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মুঠোফোন ব্যবহার কমে এলেও শূন্যে নামানো যাচ্ছে না। প্রযুক্তি, জনবল, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা, সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। অতীতে নিয়োগে গলদের কারণে অনুপযুক্ত লোক ঢুকে গেছে, যাদের সংশোধন কঠিন হয়ে পড়েছে।