যোগাযোগব্যবস্থায় ‘গেমচেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচিত ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রকল্পটির সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দর ও পাতাল মেট্রোরেলের সংযোগ স্থাপন ও গ্রেড সেপারেটর ইন্টারচেঞ্জ ট্রাম্পেট যুক্ত করে এটাকে মাল্টিডাইমেনশনাল হাবে রূপান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে যুক্ত সেতুর উচ্চতা ও পিলারের নকশাও বদলানো হচ্ছে। এতে খরচ বাড়লেও সুবিধা বহুগুণ বাড়বে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
তবে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় বৃদ্ধিতে চ্যালেঞ্জে পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দাবি- প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় পেলে মাত্র দুই বছরের মধ্যেই উড়াল সড়কটি চালু করা সম্ভব। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানী থেকে দেশের চতুর্দিকে যাতায়াত ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। উড়াল সড়কটি শাহজালাল বিমানবন্দরের বিপরীত দিকে কাওলা থেকে শুরু হয়ে আশুলিয়া-জিরাবো-বাইপাইল হয়ে ইপিজেড ও শ্রীপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে। এর সুবিধাভোগী হবে রাজধানীসহ অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি জেলার মানুষ।
প্রকল্পের ২৪ কিলোমিটার মূল সড়ক, ১০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার র্যাম্প, নবীনগরে ১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার উড়ালপথ এবং ২ দশমিক ৭২ কিলোমিটার সেতু- সব মিলিয়ে একটি বৃহৎ ও আধুনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে উড়াল সড়কটি ঘিরে। এর মাধ্যমে ইপিজেড ও আশুলিয়া, জিরাবো বাইপাইলসংলগ্ন কলকারখানা, গার্মেন্টস ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য চট্টগ্রাম-সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন ও যাতায়াত হবে আরও দ্রুত ও সহজ। তবে ২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি এখনো ৫৬.৫ শতাংশ।
জানা গেছে, বাস্তবায়নে ধীরগতি ও নকশায় পরিবর্তনে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে ৫৫ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালে একনেক অনুমোদনের সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। পরবর্তীতে নকশা পরিবর্তন, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যহ্রাস, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি, কর ও শুল্ক যুক্ত হওয়ায় প্রথম সংশোধনে ব্যয় বেড়ে হয় ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৭ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, যা এখন সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২৮ সালের জুন।
নথি বলছে, ২০১৭ সালে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের পর ডিপিপি অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। কিন্তু, দাতা সংস্থার সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্পন্ন করে কাজ শুরুই হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। ওই বছরের জুনে প্রথম ডিপিপি সংশোধন করা হয়। ব্যয় ৬৫২ কোটি টাকা বাড়িয়ে সম্পন্নের সময়সীমা ধরা হয় ২০২৬ সালের জুন।
ব্যয় ও সময়সীমা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রথম সংশোধনের সময় ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা, এখন সেটা ১২২ টাকা। শুধু ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণেই অতিরিক্ত দরকার হচ্ছে ৩ হাজার ৭৩৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৯ হাজার ৬৮০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ ব্যয়ের মধ্যে ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি (৩৭.৭৪%) টাকা ব্যয় হবে ভৌত কাজ, ভূমি অধিগ্রহণ, ৩৩ কেভি/১১ কেভি বৈদ্যুতিক লাইন স্থানান্তরসহ অন্যান্য ইউটিলিটি অপসারণ কাজে। এর মধ্যে ১৯৩০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী নকশা বদলাতে গিয়ে। বিআইডব্লিউটিএর চাহিদার কারণে তুরাগ নদের ওপরে সেতুর পিলারের উচ্চতা ও দূরত্ব বাড়াতে হচ্ছে। রেলওয়ের চাহিদার কারণে রেললাইনের পাশে উড়াল সড়কের নকশা বদলাতে হচ্ছে। বাকি ৬ হাজার ২৬ কোটি টাকাই (৬২.২৬%) লাগছে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি ও ‘রেগুলেটরি ভ্যাট, ট্যাক্স ও কাস্টমস ডিউটিজ’ বাবদ। এর মধ্যে ১৫৮৬ কোটি টাকা সরকারি খাতেই জমা হবে। তবে এই ব্যয়ের কারণে উড়াল সড়কে সুবিধা বাড়বে বহুগুণ। কারণ অনেক জরুরি পরিবর্তন আনা হয়েছে নকশায়, যেটা দু-চার বছর পর হলেও করতে হবে। তখন ব্যয় আরও দু-তিন গুণ বাড়বে। নকশা পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আশুলিয়া থেকে বাইপাইল ও ইপিজেড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অনেক স্থাপনা ও উচ্চ ভোল্টের বিদ্যুতের লাইনের কারণে সংশোধিত ডিপিপিতে এখানে আন্ডারগ্রাউন্ড করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এতে জমি অধিগ্রহণের খরচ কমেছে। মূল সড়ক থেকে নামতে আগে বাইপাইল থেকে ৫০০ মিটার আগে শুধু একটা র্যাম্প ধরা ছিল প্রকল্পে। অথচ, বাইপাইল তিনমুখী রাস্তা। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৫-৩০টি জেলার যানবাহন এ ত্রিমুখী জাংশন দিয়ে চলাচল করে। এখন সেখানে একটা গ্রেড সেপারেটর ইন্টারচেঞ্জ ট্রাম্পেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে বিরতিহীন সবদিকে গাড়ি যেতে পারবে। মূল ডিপিপিতে শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ ছিল না। আমরা সংযোগ করে দিতে চাচ্ছি। বিমানবন্দরের কাছে পাতাল মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটার সঙ্গেও এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ দিতে চাচ্ছি।
এতে এয়ার, মেট্রোরেল ও সড়ক নিয়ে একটা মাল্টিডাইমেনশনাল হাব সৃষ্টি হবে। এজন্য ডিপিপি সংশোধন করতে হচ্ছে। বিনিয়োগকারী চীনের এক্সিম ব্যাংক এসব পরিবর্তন ও অতিরিক্ত ব্যয় বহনে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদন। দ্রুত অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ পেলে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। সড়কটির স্থায়িত্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী করতে উপকরণে মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিটা পণ্য আমরা ল্যাবে টেস্ট করে ব্যবহার করছি। তবে অগ্রাধিকার দিচ্ছি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দেশি পণ্যে, যাতে নিজেদের অর্থনীতিরও ভালো হয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ না পড়ে। এতে আমাদের আমদানি শুল্কও দিতে হবে না। যেসব উপকরণ দেশে পাচ্ছি না, শুধু সেগুলো আমদানি করছি। তবে আন্তর্জাতিকমানের সিমেন্ট, রড, বিটুমিন আমরা দেশেই পাচ্ছি। প্রকল্পে বসুন্ধরা, শাহ, ক্রাউন, সেভেন রিং, ফ্রেস সিমেন্ট ব্যবহার করছি।
বিটুমিন ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বসুন্ধরা থেকে নিচ্ছি। ৬০ ও ৭০ গ্রেডের পাশাপাশি বসুন্ধরার পলিমার বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আর কেউ এই বিটুমিন উৎপাদন করে না। এটা আমরা ল্যাবে পরীক্ষা করেছি। খুবই ভালো। পলিমার বিটুমিন একটা আধুনিক প্রযুক্তিগত, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বিটুমিন। এটা পানিতে নষ্ট হয় না, ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহনশীল। এটা ব্যবহার করলে গ্রীষ্মের গরমে গাড়ির চাকার ঘর্ষণে সড়ক থেকে পিচ সরে যাবে না। নির্মাণ কাজটি হবে গুণগত মানসম্পন্ন ও টেকসই।