বনানী কাঁচাবাজার মার্কেট ভবন ও ফুটপাতের মাঝখানে খালি জায়গাটি উক্ত মার্কেটের গ্রিন জোন হিসেবে নির্ধারিত আছে ডিএনসিসি’র (ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন) মাস্টার প্ল্যান-এ। তাই এখানে দোকান তৈরি বা বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই। অতীতে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে এক সময় কাঁচাবাজার মার্কেটের এই গ্রিন জোনে অবৈধভাবে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর ওই অবৈধ বরাদ্দ পরবর্তীতে বাতিলও করা হয়। এবং পরবর্তীতে এক পর্যায়ে ২০২২ সালে এইসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদও করা হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ঘুষের লোভে এই স্থানটিতে নতুন করে দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন। এখানে মোট দোকানের সংখ্যা ৩৯টি। বনানী কাঁচাবাজার মার্কেট ভবনের তিন পাশের দেয়াল ঘেঁষে নতুন বরাদ্দের এই ৩৯টি দোকান তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৬টি দোকান বেশি তৈরি হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দেওয়ার জন্য। বাকি ৩৬টি দোকানের প্রতিটির বিপরীতে ১৫-২০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এতে ডিএনসিসি প্রশাসকের ব্যক্তিগত আয় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুধুমাত্র এই ৬ কোটি টাকা ঘুষের লোভেই ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এই অবৈধ দোকান বরাদ্দের কাজে হাত দিয়েছেন। তবে এতে যেহেতু দোকান বরাদ্দ বা তৈরির কোনো সুযোগ নেই, তাই একটি ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। বরাদ্দের কাগজপত্রে ‘দোকান’ এর পরিবর্তে ‘স্পেস’ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ডিএনসিসি আইনে ‘স্পেস’ বা ‘দোকান’ বরাদ্দের বিষয়ে কমিটির অনুমোদনের কথা বলা আছে। ডিএনসিসি-তে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি কার্যকর আছে। অথচ আলোচ্য এসব দোকান বরাদ্দের নথি ওই কমিটিতে উপস্থাপনই করা হয়নি। ডিএনসিসির প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা নিজেদের মধ্যে নথি চালাচালি করে অবৈধ এসব দোকান বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছেন। যা সরাসরি ডিএনসিসি আইনের লঙ্ঘন।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, কাগজপত্রে অস্থায়ীভাবে ‘স্পেস’ বরাদ্দের কথা বলা হলেও বাস্তবে এখানে পাকা দোকান উঠে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এসব দোকানের ইটের গাথুনিও উঠে গেছে। মার্কেটের দোকানদার এবং আশপাশের সড়কের ব্যবসায়ীরা জানান, কোনো ভবনের দেয়াল সংলগ্ন দোকান হতে পারে, এটা কোথাও দেখেননি তারা। ফুটপাত এবং দেয়ালের মাঝখানের খালি জায়গায় দোকান তৈরি করায় মার্কেটের অগ্নিঝুঁকি বাড়বে। ওই দোকানগুলো উচ্ছেদ করার পর মার্কেট, ফুটপাত ও আশপাশের পরিবেশ সুন্দর হয়েছিল। নতুন করে দোকান তৈরি হওয়ায় আবারও এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে, ফুটপাত বেদখল হয়ে যাবে। গত ১৭ আগস্ট ডিএনসিসি নতুন করে এসব দোকান বরাদ্দ করেছে।
ডিএনসিসির সূত্রমতে, ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে এই বরাদ্দ প্রস্তাব উঠলে এর অনুমোদন মেলার কথা ছিল না। কারণ, বনানী কাঁচাবাজার মার্কেট ভবনের দেয়াল ঘেঁষে নির্মিত আগের দোকানগুলো পাশের ফুটপাত ও সড়ক দখল করত। এতে ওই এলাকায় মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হতো। ২০২২ সালে ডিএনসিসি জনস্বার্থ বিবেচনা করে সেসব দোকান উচ্ছেদ করে। এরপর থেকে ওই মার্কেটের দু’পাশের সড়কের ফুটপাতে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ছিল। মার্কেটের আলো-বাতাস ও খোলা জায়গায় বের হওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষ চলাচল করতে পারত। ডিএনসিসির এই উদ্যোগ সাধুবাদ কুড়িয়ে ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এখন নতুন করে আবার ওইসব জায়গায় দোকান বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগকে কেউই ভালো চোখে দেখছেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালের মার্চে ডিএনসিসির বনানী কাঁচাবাজারে আগুন লাগে। তখন মার্কেটের নিরাপত্তা বিবেচনায় দেয়াল ঘেঁষে অস্থায়ী বরাদ্দ দেওয়া ৩৩টি দোকান বাতিল করে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। এরপরও ওইসব দোকানদাররা সেখানে ব্যবসা অব্যাহত রাখে। ২০১৭ সালে ওই দোকানদাররা দোকানের বকেয়া ভাড়া পরিশোধের আবেদন জানায়। পরে ডিএনসিসি ২০১৯ সালে বনানী কাঁচাবাজার মার্কেট ভবনের দেয়াল ঘেঁষে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনাকারীদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিলেও তা রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। তবে শেষমেশ ২০২২ সালের জুলাই মাসে ওই দোকানগুলো উচ্ছেদ করে ডিএনসিসি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর ওই দোকানগুলো বরাদ্দ পেতে ব্যবসায়ীরা নগর ভবনে যাতায়াত শুরু করেন।
তারা ২০১৬ সালে দোকান বাতিল করার পর থেকে ২০২২ সালে উচ্ছেদ করা পর্যন্ত বিনা ভাড়ায় দোকান পরিচালনা করায় সেসব বকেয়া পরিশোধ করে দোকান বরাদ্দ পেতে আবেদন করেন। তাদের এই ফাঁদে পা দেয় ডিএনসিসির অসাধু চক্রটি। তারা বরাদ্দ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ফাইল উপস্থাপন করে বরাদ্দ করেছে ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে। নিয়ম অনুযায়ী ১১ সদস্যবিশিষ্ট বরাদ্দ কমিটির কাছে প্রস্তাবটি উত্থাপন করার নিয়ম রয়েছে। ওই কমিটি বরাদ্দের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে-এমনটিই আইনে বলা হয়েছে। এছাড়াও আইন অনুযায়ী বরাদ্দ বাতিলের ৩০ দিনের মধ্যে জরিমানা হিসাবে ১২ মাসের সমপরিমাণ টাকার পে-অর্ডার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর জমা দিয়ে পুনঃবরাদ্দের আবেদন করতে হয়। এক্ষেত্রে তারা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি।
নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ বাতিলের পর ওইসব দোকান অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। অবৈধ দোকানের বিপরীতে ভাড়া আদায়ের কোনো সুযোগ নেই। অথচ এক্ষেত্রে ডিএনসিসি বরাদ্দ বাতিলের প্রায় ১০ বছর পরে এখন বকেয়া ভাড়া আদায় করেছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য দোকান বরাদ্দ দিয়েছে বলে সম্পত্তি বিভাগ দাবি করছে। কিন্তু আসল কাহিনী হলো, ঘুষের লেনদেন।
প্রশাসক এজাজ ছাড়াও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান এবং প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার পিও মিলনের জন্য আলাদাভাবে নির্ধারিত অংকের টাকা তোলা হয়েছে প্রতিটি দোকানের বিপরীতে।
ডিএনসিসি সূত্রগুলো বলছে, এই দোকান বরাদ্দ ছাড়াও প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের যাবতীয় অবৈধ কর্মকাণ্ডে নির্দ্বিধায় সহযোগিতা করে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত ওসমান। এতে তারা নিজেরাও আখের গুছিয়ে নিতে পারছেন। অবশ্য, সহযোগিতা না করলে বিপদও আছে। প্রশাসকের এসব অন্যায়-অবৈধ কাজ করতে যদি কোন কর্মকর্তা রাজি না হন তবে ওই কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলিসহ নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। এ পর্যন্ত একজন অতিরিক্ত সচিবসহ প্রশাসন ক্যাডারের অন্ততঃ ৬ জন কর্মকর্তাকে এ ধরনের অন্যায় বদলি ও হয়রানি করেছেন প্রশাসক। তবে প্রেষণে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য একাধিকবার ডিও-সহ ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করেও এই অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কারণ, তার দাবি এবং আবদার ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
শীর্ষনিউজ