নওগাঁর মমতাজ বেগম। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ এক গৃহিণী। ২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন। ১৭তম সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলে তাঁর বড় ছেলে মাহমুদুল হোসেন মুন্নার নাম আসতেই পাড়াপ্রতিবেশীরা তাঁকে ‘জজের মা’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন। ছেলের সাফল্যে গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে মমতাজ বেগমের সেই আনন্দ এখন শুধুই বিষাদ।
গত ২৭ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয় সহকারী জজ নিয়োগের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে। সেখানে সুপারিশপ্রাপ্ত ১০২ জনের মধ্যে স্থান হয়নি মাহমুদুল হোসেনের। কেন বাদ পড়েছেন, এর কোনো যৌক্তিক কারণও উল্লেখ করা হয়নি। সেই থেকে মমতাজ বেগমের কান্না আর থামছে না। রাষ্ট্রের কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘তাঁদের চোখের জলের কি কোনো মূল্য নেই?’
শুধু মমতাজ বেগমের ছেলে নন, ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন ১৩ জন মেধাবী শিক্ষার্থী। অভিযোগ উঠেছে, সংবিধান, মেধা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা উপেক্ষা করে ‘নেতিবাচক’ পুলিশি প্রতিবেদনের পুরোনো প্রথা মেনেই আটকে দেওয়া হয়েছে তাঁদের নিয়োগ।
স্বপ্নভঙ্গ ও পারিবারিক হাহাকার
মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে। ওদের বাবা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন। টানাটানির সংসারে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলে থাকতাম। ছেলেরাও আমাদের আশাহত করেনি। বড় ছেলে এসএসসি ও এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়। রাজনৈতিক দলাদলি অপছন্দ বলে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠেনি। টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমার সোনার ছেলে মেধার স্বাক্ষর রেখে জজের পরীক্ষায় টিকল, আর এখন শুনছি পুলিশ নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা রাজনীতির সাতেপাঁচে কোনো দিন ছিলাম না। তবু কেন এই অপরাজনীতির শিকার হতে হলো? জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছোট ছেলেকে ঘরে আটকে রাখিনি। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও মিছিলে পাঠিয়েছি...। কিন্তু আমার ছেলের সঙ্গে যে অন্যায় হলো, তার প্রতিকার কে করবে?’
বাদ পড়া মাহমুদুল হোসেন মুন্না বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। চূড়ান্তভাবে সফলও হয়েছিলাম। কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও আমাকে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো, তা মেনে নেওয়া কঠিন। মা–বাবার মুখের দিকে এখন তাকাতে পারছি না।’
রাষ্ট্রীয় অসংগতির এক নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইমন সৈয়দের ঘটনায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোয় যখন অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন, তখন তরুণ আইনজীবী সাইমন প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রামে কোনো এইচএসসি পরীক্ষার্থী কারাগারে থাকলে দ্রুত যোগাযোগ করুন। জুলাই যোদ্ধাদের সম্পূর্ণ বিনা ফিতে মুক্ত করব ইনশা আল্লাহ।’
অথচ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের আমলেও জজ নিয়োগের গেজেট থেকে বাদ পড়েছেন সাইমন। এর আগে চারবার মৌখিক পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েছিলেন তিনি। পঞ্চমবারের চেষ্টায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েও পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাঁর সহপাঠীরা। এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনে আর্থিক লেনদেনের যে গুঞ্জন শোনা যায়, সাইমনের বাদ পড়া সেই সন্দেহকেই জোরালো করছে।
পুরোনো বৃত্তেই আটকে আছে পুলিশ ভেরিফিকেশন
গেজেটভুক্ত না হওয়া আরেক প্রার্থী অনিক আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক ট্যাগ এড়াতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবন মেসে কাটিয়েছি। হলে উঠিনি। তবু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ধুয়া তুলে আমাকে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে লিখিত এবং চলতি বছরের শুরুতে মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০২ জনকে চূড়ান্ত সুপারিশ করে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন। দীর্ঘ ১০ মাস পর গত বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) আইন মন্ত্রণালয় যে গেজেট প্রকাশ করে, সেখানে ৮৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাদ পড়া ১৩ জন হলেন—রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তানসেনা হোসেন মনীষা, অনিক আহমেদ, মাহমুদুল হোসেন মুন্না ও গগন পাল; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশাত মনি, নাহিম হাসান, রেজাউল ইসলাম ও সাজ্জাদুল হক; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইমন সৈয়দ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মামুন হোসেন; গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিকুর রহমান; বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুব্রত পোদ্দার এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হুমায়রা মেহনাজ। আরেকজন প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা না হওয়ায় তাঁর পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়নি।
সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার কথা বলা থাকলেও পুলিশি যাচাইয়ের নামে মেধাবীদের আটকে দেওয়ার এ প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন আইনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএসে বাদ পড়া ২৫৯ জনকে নিয়োগ দিয়ে প্রশংসিত হলেও বিজেএস নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই পুরোনো রাজনৈতিক যাচাইপ্রক্রিয়া বহাল রেখেছে।

শিক্ষার্থী ও বিশিষ্টজনদের ক্ষোভ-প্রতিবাদ
চাকরিক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলেও ১৭তম সহকারী জজ নিয়োগের চূড়ান্ত ফল সেই প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের মতে, শুধু পরিবার বা আত্মীয়দের রাজনৈতিক পরিচয়ের সন্দেহের ভিত্তিতে ১৩ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী। তিনি লিখেছেন, ‘প্রশ্ন হলো, যদি এটাই হয় নতুন বন্দোবস্ত, তবে পুরোনো বন্দোবস্তের সাথে অমিলটা কোথায়?’ তাঁর এই পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করেছেন কবি ও চিন্তক ব্রাত্য রাইসু।
উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান, মেধা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা উপেক্ষা করে “নেতিবাচক” পুলিশ প্রতিবেদনের পুরোনো প্রথা মেনেই ১৩ জনের নিয়োগ আটকে দেওয়া হয়েছে, যা কাম্য নয়।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু, রাকসু, চাকসু, জাকসু) সম্মিলিত বিবৃতিতে তীব্র উদ্বেগ জানানো হয়েছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ১৩ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ না পেলে সংশোধিত গেজেট প্রকাশ এবং সব চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতাকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে ১৩ জন চাকরিপ্রার্থীকে বিনা শর্তে গেজেটভুক্ত করার দাবি জানান।
আইন উপদেষ্টার বক্তব্য
১৩ জন প্রার্থীর নিয়োগ আটকে যাওয়া এবং শিক্ষার্থী ও বিশিষ্টজনদের উদ্বেগের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রথম আলোকে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১৩ জন প্রার্থীর নিয়োগ আটকে দেওয়া হয়নি। অস্পষ্ট পুলিশি প্রতিবেদন থাকার কারণে পুনরায় মতামত চাওয়া হয়েছে। তাদের নিয়োগ কিছুদিন পরে হলেও তা সিনিয়রিটিতে ব্যাঘাত করবে না। তবে এ পরিস্থিতি তাদের জন্য যে অনিশ্চয়তা ও বেদনাবোধ এনে দিয়েছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। পুলিশি প্রতিবেদনের প্রচলিত ধারা বদলানো যায় কি না, তা বিবেচনার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে আমি অনুরোধ করব।’