একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও রাখাইন সীমান্তকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের প্রবাহ এক ধরনের আঞ্চলিক নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করছে। নিরাপত্তা সংস্থার দাবি, পার্বত্য তিন জেলায় উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন করে অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, যা অঞ্চলটিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছে।
সীমান্ত অঞ্চলে অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক, মানবপাচার ও অবৈধ অনুপ্রবেশ সবকিছুই একই সাথে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেয়া একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে ত্রিপুরা, মিজোরাম ও রাখাইন সীমান্তকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের প্রবাহ এক ধরনের আঞ্চলিক নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কেবল অক্টোবর মাসেই সীমান্ত জেলাগুলোতে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ১৭টি পিস্তল, ১৪টি বন্দুক, দু’টি শর্টগান, দু’টি শুটারগান, দু’টি ম্যাগজিন, ৩৬টি কার্তুজ, ২৭ রাউন্ড গুলি ও দুই রাউন্ড অ্যামুনিশন উদ্ধার করেছে। নিরাপত্তা সংস্থার দাবি- পার্বত্য তিন জেলায় উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন করে অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, যা অঞ্চলটিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ভারতের ভূমিকা ও পুশইন ইস্যু : অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ বাড়ছে বাংলাদেশে : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গৃহীত কিছু পদক্ষেপের ফল হিসেবে বাংলাদেশের দিকে নতুন করে অবৈধ অনুপ্রবেশের চাপ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, ভারত ১৭টি সীমান্ত জেলা দিয়ে বাংলাদেশী, রোহিঙ্গা ও কিছু ভারতীয় নাগরিককে পরিকল্পিতভাবে পুশইন করছে।
অক্টোবর মাসে বিএসএফ ৬৫৯ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে; মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে আরো ৪৩২ রোহিঙ্গা। গত পাঁচ মাসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৮১৮ জন, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে (৩০৮ জন)।
ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে আসাম সরকারের অনুমোদিত নতুন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি), যা বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে দ্রুত বহিষ্কার করার প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা- এই সিদ্ধান্তের ফলে পুশইন আরো বৃদ্ধি পাবে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার ওপর।
সীমান্তে মৃত্যুর মিছিল : বিএসএফের গুলিতে নিহত চার বাংলাদেশী : অক্টোবর মাসে সীমান্তে প্রাণহানির চিত্র আরো ভয়াবহ। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে চার বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ অক্টোবর হবিগঞ্জের চুনারুঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করা তিন বাংলাদেশী- পণ্ডিত মিয়া, সজল ও জুয়েল। স্থানীয়দের হাতে নির্মম পিটুনিতে মারা যান। ২৬ অক্টোবর কানাইঘাট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়াদের ছররা গুলিতে নিহত হন শাকিল।
এ ছাড়া অক্টোবরজুড়ে অবৈধ গমনাগমনের সময় ২১০ বাংলাদেশী এবং তিন ভারতীয়কে আটক করেছে বিজিবি।
জেএসএস-ইউপিডিএফের তৎপরতা বাড়ছে : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি সীমান্তে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সদস্যরা নিয়মিত ত্রিপুরা-মিজোরাম এলাকায় যাতায়াত করছে, যা একটি ট্রান্সবর্ডার অপারেশনাল নেটওয়ার্ককে নির্দেশ করে। তিন পার্বত্য জেলায় অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা এই সংগঠনগুলোর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
মাদক প্রবাহ : কমছে উদ্ধার, বাড়ছে পাচারের ধরন : অক্টোবর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২৩ হাজার ৬৮৭টি অভিযান চালিয়ে দুই হাজার ৭৪১ জনকে আটক করেছে এবং সীমান্ত থেকে উদ্ধার করেছে- ১০ হাজার ৫৪৭ বোতল ফেনসিডিল; ২৬ লাখ ২৭ ঞাজার ৭৪৬ পিস ইয়াবা; ১১ কেজি হেরোইন ও ১২ কেজি গাঁজা।
তবে গোয়েন্দা সংস্থার মতে, উদ্ধার হওয়া মাদকের তুলনায় পাচার হওয়া মাদক কয়েক গুণ বেশি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মেহেরপুর ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে ‘ট্রাডিশনাল ড্রাগস’-এর পাশাপাশি সিনথেটিক ড্রাগস প্রবেশ এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। পাচারকারীরা বেশি লাভের কারণে সিনথেটিক ড্রাগসের দিকে ঝুঁকছে।
রাখাইন সীমান্ত : নতুন যুদ্ধক্ষেত্র : আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে পুরো স্থল সীমান্ত : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বর্তমানে বিওপি ৩১-৫৪ পর্যন্ত পুরো স্থল সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
সঙ্ঘাতের কারণে নিয়মিত গোলাগুলি, নিরাপত্তাহীনতা এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষ সীমান্তবাসীর জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর চলাচল ঠেকাতে পথেঘাটে ল্যান্ড মাইন পেতে রাখছে- যার কারণে সশস্ত্র গোষ্ঠী ছাড়াও সাধারণ মানুষ আহত হচ্ছে।
সীমান্ত নিরাপত্তায় নীতি-সুপারিশ : গোয়েন্দা সংস্থাটি চারটি কৌশলগত সুপারিশ করেছে- পুশইন ও অনৈতিক তৎপরতা প্রতিরোধে জনসাধারণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা। অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালান রোধে সীমান্ত বাহিনীর নজরদারি শক্তিশালী করা। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ঘুমধুম, বান্দুলা ও চাকডালা এলাকায় বর্ডার হাট স্থাপন, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বিকল্প তৈরি হয় এবং চোরাচালান কমে। সীমান্ত বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিধি বাড়ানো।
সীমান্ত সঙ্কট এখন বহুমাত্রিক : গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়- বাংলাদেশের সীমান্ত এখন কেবল একটি ভূরাজনৈতিক সীমারেখা নয়, বরং অস্ত্র পাচার, মাদক প্রবাহ, মানবপাচার, রোহিঙ্গা সঙ্কট ও ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফলশ্রুতিতে একটি বহুমাত্রিক নিরাপত্তা সঙ্কটের অঞ্চল পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত নিরাপত্তা, কূটনৈতিক চাপ, আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বিকল্প- সবকিছু একসাথে শক্তিশালী করাই হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।