শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হঠাৎ সক্রিয়তা, অপরাধীদের দ্বন্দ্বের জেরে খুনোখুনি, সীমান্ত পথে আসা অবৈধ অস্ত্র-গুলির কয়েকটি চালান জব্দের ঘটনা সাধারণ মানুষকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে পাঁচ শতাধিক অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অবশ্য পুলিশ বলছে, নির্বাচনে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কোনো হুমকি নয়। তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এক নির্বাচনে ভোটারদের ভয় দেখানো, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর হামলা এবং ফলাফল প্রভাবিত করতে অপরাধী চক্রগুলোকে ভাড়াটে পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে সরকারের সূত্র বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই সারা দেশে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলদার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে।
জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গত শনিবার সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, জামিনে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। পারলে এত দিনে অনেক কিছুই করে ফেলত।
নির্বাচনে তারা কোনো হুমকি নয়। পুলিশ তাদের পরোয়া করে না।
চট্টগ্রামে গত ৫ নভেম্বর বিএনপির প্রার্থীর গণসংযোগে ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন বাবলাকে, ১০ নভেম্বর রাজধানীতে আদালতপাড়ার কাছে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে এবং গতকাল রোববার খুলনায় আদালতের ফটকের বাইরে প্রকাশ্যে দুজনকে হত্যা অপরাধী চক্রের দ্বন্দ্বে খুনোখুনিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। বাবলা ও মামুন হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের তির প্রতিপক্ষ শীর্ষ সন্ত্রাসীর দিকে। খুলনায় গুলি করে ও কুপিয়ে দুজনকে হত্যাও সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্বের জের।
খুলনায় গতকাল নিহত ফজলে রাব্বি রাজন ও হাসিব হাওলাদারের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ছয়টি করে মামলা ছিল। খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম জানান, নিহত দুজনই সন্ত্রাসী পলাশ গ্রুপের সহযোগী ছিলেন এবং আড়াই মাস আগে জামিনে কারাগার থেকে বের হন।
ঢাকার পল্লবীতে ১৭ নভেম্বর থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে দোকানে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পেছনেও রয়েছে অপরাধী চক্রের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার চরাঞ্চলে বিএনপির দুই পক্ষের সমর্থককে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর কারাগার থেকে আলোচিত ১৭৪ জন আসামি মুক্তি পায়। তাদের মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় রয়েছে। জামিনের পর তাঁদের অনেকে লাপাত্তা। জামিনে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সুইডেন আসলাম, সানজিদুল ইসলাম ইমন, পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী, টিটন, ফ্রিডম রাসু। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ফেরা কেউ কেউ এলাকা নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও পুরোনো অনুসারীদের সক্রিয় করে তুলছে। বড় সন্ত্রাসীদের পাশপাশি তাদের সহযোগীরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সূত্রগুলো বলছে, সুব্রত বাইন গ্রেপ্তারের পর জিসান গ্রুপ মগবাজার থেকে মহাখালী পর্যন্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ইমনের সহযোগীরা মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
চট্টগ্রামের পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ বিদেশে বসে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। গত বছরের আগস্ট থেকে ১০টি হত্যাকাণ্ডে সাজ্জাদ গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সরোয়ার বাবলা ও আকবর হত্যাকাণ্ডও রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, জামিনে থাকা কোনো অপরাধী নতুন করে অপরাধ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী দাবি করেছেন, ঢাকার অপরাধ পরিস্থিতি আগের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে। ছিনতাই ও দিনেদুপুরে হামলা কমেছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখেছে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সূত্র বলছে, সীমান্তের কমপক্ষে ১৮টি স্থান দিয়ে চোরাচালানের অস্ত্র-গুলি ঢুকছে। এর মধ্যে বেশি আসছে টেকনাফ, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও মেহেরপুর দিয়ে। মাঝে মাঝে অস্ত্রের চালান জব্দও করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ গত শনিবার যশোরে জব্দ করা হয়েছে ৫টি বিদেশি পিস্তল ও ৫০টি গুলি। সীমান্তপথে আসা এসব অস্ত্র-গুলি জব্দ করেছে যশোরের জেলা ডিবি পুলিশ। সূত্র বলেছে, এগুলোর গন্তব্য ছিল কক্সবাজার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, গত বছরের ১ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত র্যাব ২১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে, গ্রেপ্তার করেছে ১১২ জনকে। বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বছরের প্রথম ১০ মাসে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৩৭৭টি অস্ত্র।
গত বছরের ৫ আগস্ট থানাগুলো থেকে লুট হওয়া পুলিশের পাঁচ শতাধিক অস্ত্রের এখনো খোঁজ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলোর বড় অংশ অপরাধীদের হাতে রয়েছে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় আবার অপরাধে ফিরছে। শহরে গুলি করে হত্যা সেটার ইঙ্গিত বহন করছে। চিহ্নিত এই অপরাধীদের এখনই গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার না করলে নির্বাচনের পরিবেশ শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।