Image description

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা হলেও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এবার সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগ সামনে এসেছে। ইতিমধ্যে তার নানা দুর্নীতির অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। সাবেক কোনো চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এটাই প্রথম।

ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থের বিনিময়ে রাঘববোয়ালদের অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে মুক্তি, নামে-বেনামে সম্পদ অর্জন এবং কানাডায় অর্থপাচার বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক।

দুদক মহাপরিচালক (লন্ডারিং) মো. মোকাম্মেল হক তদন্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, সাবেক দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন এই তদন্ত শুরু হয়েছে স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ১৬১ ধারায় দেয়া জবানবন্দির সূত্র ধরে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও তথ্য সহায়তা নেয়া হয়েছে।

সূত্রটি জানায়, তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

তদন্তের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, “ইকবাল মাহমুদের দুর্নীতি সাদা চোখে ধরা পড়তো না। কয়েক হাত ঘুরে ভাই-বেয়াইসহ বিভিন্ন আস্থাভাজন ব্যক্তিদের মাধ্যমে দুর্নীতিলব্ধ অর্থ বিদেশে পাচার করতেন তিনি।”

জানা গেছে, স্বাস্থ্যখাতের আলোচিত দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এবং ইকবাল মাহমুদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। ২০০২ সাল থেকে তাদের সম্পর্ক। ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল মিঠুর। ইকবাল মাহমুদের ভাই সাদিক মাহমুদ বকুল ছিলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ব্যবসায়িক সহযোগী। এই সম্পর্কের সুবাদেই স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ আমলে ইকবাল মাহমুদের প্রভাবের কারণে মিঠু ও বকুল দীর্ঘদিন ছিলেন অধরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “ইকবাল মাহমুদ ঠিকাদার মিঠুর কাছ থেকে ঢাকার গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন।”

এই অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে কানাডায় অর্থপাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়েও অনুসন্ধান চালানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এছাড়া সাদিক মাহমুদ বকুলের সম্পদের উৎস, বিদেশে সম্ভাব্য লেনদেন এবং যৌথ ব্যবসার আর্থিক তথ্যও পর্যালোচনা করবে দুদক।

এদিকে স্বাস্থ্যখাতে সিন্ডিকেট করে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে গত ১১ সেপ্টেম্বর মিঠুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নানা তথ্য মিলেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে দুদক বলছে, স্বাস্থ্যখাতের বিস্তৃত অনিয়ম, পাচারকৃত অর্থ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ ওই বছর ১৫ অক্টোবর দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বরাবর একটি আবেদন করেন। কিন্তু মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ অভিযোগটি ধামাচাপা দেন।

ওই আইনজীবীর অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ইকবাল মাহমুদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন। তার আপন দুই ভাই বকুল মাহমুদ ও মুকুল মাহমুদ ‘মেসার্স মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি’র নামে ইকবাল মাহমুদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, যা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

এসব ব্যক্তির জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান শেষে দুদক আইন-২০০৪ এর ২৭ ধারায় মামলা দায়ের, তদন্ত সম্পন্ন ও অভিযোগপত্র দাখিল করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে এ আবেদন করা হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকালেই ইকবাল মাহমুদ কানাডায় গড়ে তোলেন সম্পদ। দুদক চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর বেনামে করেন বিপুল সম্পদ। সাভারে রয়েছে তার বিশাল বাড়ি।

ইকবাল মাহমুদ দুদকের চেয়ারম্যান থাকাকালে তার ছোট ভাই বকুল রাজধানীর বনানীর ‘আমিনা প্যালেস’ (ফ্ল্যাট-২এ, প্লট-১৩৯, রোড-৪, ব্লক-‘এ’, বনানী, ঢাকা-১২১৩) এ বিকল্প ‘দুদক অফিস’ খুলে বসেন। ঠিকাদারি ব্যবসার আড়ালে তার মূল কাজই ছিল দুদকে তদবির। রাত যত গভীর হতো এখানে বেড়ে যেতো রহস্যময় ও বহুরূপী মানুষদের আনাগোনা। ইকবাল মাহমুদ দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রাজধানীর বারিধারায় (বাড্ডা) বকুলের নামে কেনেন দুটি ফ্ল্যাট। রাজউক থেকে প্রাপ্ত উত্তরার প্লটে নির্মাণ করেন বহুতল ভবন। সরকারি চাকরিজীবী রাজউক থেকে একাধিকবার সুবিধা নেয়া বেআইনি। কিন্তু ইকবাল মাহমুদ গুলশান অ্যাপার্টমেন্ট ভবন-২ (ভবন-২) ১৬টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করে। লটারিতে নির্বাচিত আবেদনকারীদের নাম ও ফ্ল্যাটের তালিকায় ৩২ নম্বরে ছিল ইকবাল মাহমুদের নাম। একেকটি ফ্ল্যাটের আয়তন সাড়ে তিন হাজার বর্গফুট।

অভিযোগ রয়েছে, এর আগেও রাজউকের উত্তরা প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ পান ইকবাল মাহমুদ। বাড়ি-২, রোড-৮, সেক্টর-১০, উত্তরা, ঢাকা। পাঁচ কাঠার প্লটের ওপর এখন ছয়তলা ভবন। ২০১২ সালে প্লটটিতে ভবন ওঠে। ডেভেলপার থেকে রেশিও অনুযায়ী তিনি চারটি ফ্ল্যাট পান। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ গ্রামের বাড়িতে রাস্তা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনিতে পিতার কর্মস্থলে ‘আব্দুল লতিফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কলেজকে তিনি এমপিওভুক্ত করান।

ইকবাল মাহমুদ দুদক চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায় নেয়ার ৬ মাস আগে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি প্রদান করে তার ভাইয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। দায়মুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে হাইকোর্টের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে দুদকের প্রতি রুল জারি করেন। রুল শুনানি শেষে ইকবাল মাহমুদের শেষ ৬ মাসে ‘নিষ্পত্তিকৃত’ পৌনে ৭ শ’ মামলা এবং অনুসন্ধান পুনঃঅনুসন্ধানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

শীর্ষনিউজ