Image description

রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহের কাছ থেকে রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের (৪৩) ২৬ টুকরা লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জরেজুল ইসলাম (জরেজ) এবং তাঁর প্রেমিকা শামীমা জড়িত বলে দাবি করছে র‍্যাব। প্রাথমিকভাবে র‍্যাব ও পুলিশ উভয় সংস্থাই এর সঙ্গে আর্থিক বিষয়ের সম্পৃক্ততার কথাও জানিয়েছিল। এ ঘটনায় জরেজ ও তাঁর ‘প্রেমিকা’ শামীমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র‍্যাব বলছে, জরেজ প্রেমিকা শামীমাকে ব্যবহার করে আশরাফুলকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করে।

আর জরেজকে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মুখপাত্র তালেবুর রহমান।

এদিকে আশরাফুল হত্যার ঘটনায় গতকাল শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম জরেজ ও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন। পরিবারের লোকজন বলেছেন, গত মঙ্গলবার আশরাফুল বন্ধু জরেজ মিয়ার সঙ্গেই ঢাকায় গিয়েছিলেন। তদন্তের শুরু থেকে জরেজুলকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

র‍্যাব বলেছে, আশরাফুল হককে খুন করে লাশ খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘটনায় জরেজের প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, জরেজ শামীমার মাধ্যমে আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে আটকে রাখে এবং জোর করে আপত্তিকর অবস্থার ছবি তোলে। এভাবে সে চাপ দিয়ে আর্থিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আশরাফুলকে হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়। আগামীকাল সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

ড্রামে ২৬ খণ্ড লাশ: নিহতের বন্ধুকে প্রধান আসামি করে মামলা করল পরিবার

এর আগে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেছিলেন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, কল রেকর্ড এবং আশপাশের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্তে কাজ চলছে। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত হত্যার কারণ বা ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ বলা যাচ্ছে না।

গতকাল বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আশরাফুল হকের খণ্ডিত মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বাড়িতে কান্নার রোল

আজকের পত্রিকার বদরগঞ্জ প্রতিনিধি গতকাল উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর নয়াপাড়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবেশ দেখতে পান। উঠানে ছিলেন প্রতিবেশী ও আশপাশের গ্রামের মানুষ। পরিবারের সদস্যরা কাঁদছিলেন। আশরাফুলের বৃদ্ধ মা এছরা খাতুন মোবাইল ফোনে ছেলের লাশের ছবি দেখে বিলাপ করছিলেন, ‘নির্দোষ বাবাটাক কেন মারল? কেন টুকরা টুকরা করল? বাবা ছাড়া হামাক কায় দেখপে? কায় মাথাত হাত দিয়া দোয়া নিবে?’

২৬ টুকরা আশরাফুলের ফোন ধরতেন মালয়েশিয়াফেরত বন্ধু জরেজ, বলতেন ‘ব্যস্ত আছে’

পরিবারের সদস্যরা জানান, আশরাফুলের বন্ধু জরেজ দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থাকার পর দেড় মাস আগে দেশে ফেরেন। এর পর থেকে জরেজের সঙ্গে আশরাফুল নিয়মিত ওঠাবসা করছিলেন। সম্প্রতি জাপানে যাওয়ার জন্য জরেজ আশরাফুলের কাছে ১০ লাখ টাকা চান।

পরিবার জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার বন্ধু জরেজের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার আগে আশরাফুল ছয়-সাত হাজার বস্তা আলু বিক্রি করেন। অন্যদিকে জরেজের স্ত্রী উম্মে কুলসুম সাংবাদিকদের বলেছেন, মঙ্গলবার তাঁর স্বামী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বুধবার চট্টগ্রামে পৌঁছানোর কথা ফোনে জানান। স্বামী ঢাকায় গিয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না।

আশরাফুলের ২৬ খণ্ড লাশ উদ্ধারের পর দেশজুড়ে তোলপাড় উঠলে জরেজের বাবা মোয়াজ্জেমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে পুলিশ।

বদরগঞ্জের গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামছুল আলম বলেন, ‘আশরাফুল আগে হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করত। পরে গ্রামে ফিরে জমিজমা কেনাবেচার কাজ শুরু করে। খুব ভালো ছেলে ছিল। কেন এমন হলো, বুঝতে পারছি না।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য মাহফুজার রহমান বলেন, আশরাফুল গত সোমবারই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওয়ারিশান সনদ সংগ্রহ করেন।

গলা থেকে পা ২৬ টুকরা লাশ, মুখে দাড়ি, আঙুলের ছাপে মিলল পরিচয়

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে রাস্তার পাশে রাখা দুটি ড্রামের একটি থেকে কালো পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় লাশের ২৬টি খণ্ড উদ্ধার করে পুলিশ। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে আশরাফুলের পরিচয় নিশ্চিত করে।

আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম বলেন, ‘আমরা বাড্ডায় থাকি। ফেসবুকে ছবি দেখে শাহবাগ থানায় যাই। সেখানে গিয়ে ভাইয়ের টুকরা টুকরা করা লাশ দেখি। আমার ভাইয়ের খুনের পেছনে যারা আছে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।’

বৃহস্পতিবার ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন। সেদিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ অনলাইনে ‘লকডাউন কর্মসূচি’ ঘোষণা করায় রাজধানীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা ছিল। হাইকোর্ট, জাতীয় ঈদগাহ এবং আশপাশে সারা দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি চলছিল। এই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেই সেখানে দুটি ড্রাম রেখে দেওয়ার ঘটনাকে রহস্যজনক মনে করছে পুলিশ।