অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা পেতে হলে ‘কর মওকুফই’ যেন শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রকল্পে বিদেশি ঋণ, কিস্তি পরিশোধ, প্রকল্পের পরামর্শকের আয়সহ নানা ক্ষেত্রে কর ছাড় চাইছে দাতা সংস্থাগুলো। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও বাজেট ঘাটতির চাপ সামলাতে যখন অতিরিক্ত ঋণের পথে হাঁটছে সরকার, তখনই উন্নয়ন সহযোগীদের কর ছাড়ের দাবি উঠছে। তাদের (দাতা সংস্থা) মতে বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন প্রকল্পে কর আরোপ মানে ‘ডাবল ট্যাক্সেশন’। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংগ্রহ নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে কর ছাড় প্রস্তাব আরও চাপে ফেলছে সরকারকে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অর্থনীতিবিদদের মতে, কর ছাড়ের সংস্কৃতি যদি ‘নীতি’ আকারে গড়ে উঠে, সেক্ষেত্রে সরকারের রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা ধীরে ধীরে হারানোরও শঙ্কা থাকবে। বিগত সময়ে অতিমাত্রায় কর ছাড় সুবিধা দেওয়ার কারণে আজ রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জন হচ্ছে না।
সূত্রমতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, কোরিয়ান এস্টাবলিস্টমেন্ট অব ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প, জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফান্ডসহ কয়েকটি সংস্থার কর ছাড়ের প্রস্তাব আসে। এ নিয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি বৈঠক করেছেন। দাতাদের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করতে সেখানে অংশগ্রহণ করেন, অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো. আনোয়ার হোসেন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান প্রমুখ। বৈঠকে প্রকল্পের আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কর ছাড় সুবিধা না দেওয়া হলে কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, সংশ্লিষ্ট আইনে এ ধরনের ছাড়ের সুবিধা বহাল আছে কিনা, ঋণ চুক্তিতে কর মওকুফসংক্রান্ত কি ধরনে ধারা অন্তর্ভুক্ত আছে এ পর্যালোচনা করা হয়। পাশাপাশি কর মওকুফ করতে সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্প চুক্তি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই বৈঠকে। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে জানান, রাজস্ব ঘাটতির কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে কর মওকুফ। তিনি মনে করেন বিগত সময় প্রভাবশালী মহলকে বেশিমাত্রায় কর মওকুফ সুবিধা দেওয়ার কারণে আজ রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। এটি বন্ধ করতে মওকুফ ব্যবস্থার ‘সুনির্দিষ্ট নীতিমালা’ প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, দাতাদের কর মওকুফ সুবিধা এখন দেওয়া হচ্ছে এডহক কমিটির ভিত্তিতে, যা উচিত নয়। এভাবে কর মওকুফ করা হলে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, ইতোমধ্যে তা পড়েছেও।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে আট হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। এনবিআরের হিসাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৯ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার পাঁচ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে সরকার এক ধরনের টানাপোড়েন অবস্থায় আছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র : বৈঠকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়ে আসছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ কারণে ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিসিএ-২০১৬ আওতায় পাওনা সুদ এবং আইজিসিএ-২০১৩ আওতায় সুদ এবং আসল বাবদ কোনো অর্থ সরকার পরিশোধ করতে পারেনি। এ জটিলতা নিরসনে উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এক্সপোর্ট (জেএসসি-এএসই) নামে সোনালী ব্যাংকে একটি ডলার লেনদেন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এরপর বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ থেকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এসক্রো (ইএসসিআরওডব্লিউ) হিসাব থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয় রাশিয়ান ফেডারেশনকে। বৈঠকে আরও জানানো হয়, প্রকল্পে অর্থ পরিশোধের বিষয়ে ২৭ আগস্ট সোনালী ব্যাংক বলেছে, বকেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে বা আগামীতে যে কিস্তি পরিশোধ হবে রাশিয়ার মনোনীত এজেন্ট জেএসসি-এএসইর মাধ্যমে। অর্থাৎ তাদের মনোনীত এজেন্ট থেকে রাশিয়ায় টাকা স্থানান্তর করবে। এক্ষেত্রে মনোনীত এজেন্টে বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ স্থানান্তর করবে তার ওপর কোনো ধরনের কর আরোপ না করা বা অব্যাহতি নিশ্চয়তা চাওয়া হয় রাশিয়ার পক্ষ থেকে।
বৈঠকে বিষয়টি পর্যালোচনা শেষে রাশিয়ার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে মনোনীত এজেন্টকে কর ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সেখানে বলা হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত শুধু রূপপুর প্রকল্পের জন্য বিশেষ বিবেচনা হবে। আগামীতে অন্য কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে এটি উদাহরণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
কোরিয়ান ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট স্থাপন প্রকল্প : ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) এক্সিম ব্যাংক কোরিয়ার অর্থায়নে ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘আইএক্সজেভিএ’ বাংলাদেশে তাদের ওপর আরোপিত আয়কর প্রত্যাহারের আবেদন করেছে। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে কোরিয়ার দ্বৈত কর আরোপ পরিহার ও রাজস্ব ফাঁকি রোধ চুক্তি স্বাক্ষর আছে। এ চুক্তির আওতায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান সরকারকে আয়কর দিচ্ছে।
বৈঠকে জানানো হয়, বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে একটি উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়। সেখানে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় আয়কর দেওয়ার প্রমাণপত্রের ওপর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইএক্সজেভিএকে বাংলাদেশে আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আয়কর পরিশোধের পর সে প্রমাণপত্র প্রদর্শন করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কর অব্যাহতি সুবিধা পেতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশে প্রকল্পের কাজ সম্পাদিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে আয়কর প্রদান করতে হবে।
এ বিষয়ে বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব বলেন, কোরিয়ান পরামর্শক ও ঠিকাদার কর্তৃক আয়কর প্রদান করতে হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোরিয়ান পরামর্শক ও ঠিকাদারদের কাজ করার আগ্রহ কমে যাবে। এর একটা প্রভাব পড়তে পারে বলে মর্মে প্রতীয়মান হয়। বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিদ্যমান ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট সংশোধন করার। এছাড়া সংশোধিত ঋণচুক্তি অনুসারে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করতে বলা হয়। যাতে সংশোধিত ডিপিপিতে ট্যাক্স ও কাস্টমস ডিউটি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট খাত হতে পরিশোধের সংস্থান রাখা হবে।
ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এফডি) : দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বিদ্যুতের টেকসই ব্যবহারসংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ইডকল। এ প্রকল্পের অর্থায়ন করছে এএফডি। প্রকল্পের ইতালিভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রিনা কনসালটিং আয়কর প্রত্যাহারের আবেদন করলে এনবিআরকে তা জানিয়ে পত্র দেয় অর্র্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। সেটি পর্যালোচনা করে এনবিআর সিদ্ধান্ত দিয়েছে আয়কর রিনা কনসালটিং প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।
ভ্যাকসিন ক্রয়ে ঋণের কর মওকুফ : ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা এবং এইচআইভি/এইডস রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে দ্য গ্লোবাল ফান্ড। গ্লোবাল ফান্ড পুরোপুরি অনুদান হিসাবে প্রদান করেছে। সংস্থাটি ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুপের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে অনুরোধ জানায়। সে প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুপের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে অবহিত করে। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে এনবিআরকে অনুরোধ জানালে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ক্ষেত্রে তা মওকুফ করা হয়। এদিকে সরকারের সঙ্গে সংস্থাটির প্রিভিলাইজ অ্যান্ড ইমিউনিটিস (পিঅ্যান্ডআই) চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ চুক্তি হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পভিত্তিক টাক্স ভ্যাট মওকুফ সুবিধা থাকবে।