Image description
বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটে স্বল্পোন্নত দেশগুলো

জাতিসংঘ জলবায় সম্মেলনে (COP30), ঝুঁকিতে পড়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর জলবায় পরিবর্তনের অর্থনৈতিক চাপ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। 'গ্লোবাল স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন অফ দ্য ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫' শীর্ষক এই পরামর্শ সভার মূল লক্ষ্য ছিল একটি নতুন সূচক (ইনডেক্স) প্রণয়নের বিষয়ে অংশীজনদের মতামত গ্রহণ, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উন্নয়নশীল অর্থনীতির ওপর সৃষ্ট ঋণ ঝুঁকি সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপ করতে পারবে।

গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত এই সেশনে LDC গ্রুপের উপদেষ্টা মনজিৎ ঢাকাল, বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের মো. জিয়াউল হক এবং বুরুন্ডির পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধিগণ অংশ নেন। বক্তারা এই সূচকের মাধ্যমে জলবায় অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর আর্থিক সুরক্ষার দাবি জোরালো করার ওপর জোর দেন।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকটের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, অথচ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে তাদের অবদান ন্যূনতম। বারবার আসা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো চরম আবহাওয়ার কারণে এই দেশগুলোকে অবকাঠামো মেরামত, পুনর্বাসন ও অভিযোজনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই অর্থ ঋণ হিসেবে নিতে হয়, যা তাদের জাতীয় ঋণের বোঝাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জলবায় সংকটের শিকার হওয়া সত্ত্বেও এই দেশগুলো এক অর্থে জলবায়ু ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে, ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫ প্রবর্তন করার লক্ষ্য হলো জলবায়জনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং অভিযোজন ব্যয়ের সঙ্গে তাদের বর্তমান ঋণের মাত্রার একটি বস্তুনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করা। এই সূচকটি কেবল আর্থিক ঝুঁকি পরিমাপ করবে না, বরং উন্নত দেশগুলোর কাছে তাদের ঐতিহাসিকভাবে জমে থাকা জলবায় ঋণ এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পর্যাপ্ত অর্থায়ন না করার ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট আর্থিক চাপকে ডেটার মাধ্যমে তুলে ধরবে। এটি একটি শক্তিশালী প্রমাণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আলোচনায় জলবায় ন্যায়বিচারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হবে।

পরামর্শ সভার বক্তারা জোর দিয়ে বলেন, এই ইনডেক্সটি একটি কার্যকর অ্যাডভোকেসি টুল হিসেবে কাজ করবে। LDC গ্রুপ এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ডেটা উপস্থাপন করতে পারবে যে, কীভাবে জলবায় অর্থায়ন অপর্যাপ্ততা তাদের ঋণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। সূচকটি জলবায় ঝুঁকিপূর্ণতা, বৈদেশিক ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার মতো একাধিক মানদণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সভায় বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত প্রতিনিধিরা জোর দেন যে, জলবায় অভিযোজন ও প্রশমনে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই আন্তর্জাতিক অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়াউল হক এবং প্যানেলিস্ট ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমদ ইঙ্গিত দেন যে, একটি কার্যকর কার্বন বাজার তৈরি এবং কার্বন ইনভেন্টরি প্রণয়নের পাশাপাশি, এই সূচকটি বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পথ দেখাবে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকসই পরিবহন এবং কার্বন সংরক্ষণে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

আলোচনায় কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, আফ্রিকার দৃষ্টিকোণও উঠে আসে। বুরুন্ডির পরিবেশ ও জলবায় পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার মতো জলবায়-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে বৈশ্বিক নিঃসরণ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে। আর্টিকেল ৬ এবং প্রস্তাবিত ডেট রিস্ক ইনডেক্স সেই যৌথ প্রচেষ্টার জন্য একটি দিক নির্দেশনা তৈরি করছে। তার বক্তব্যে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিনিময়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

'ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫' তৈরির এই বৈশ্বিক পরামর্শ সভা প্রমাণ করে যে, জলবায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন কেবল নিঃসরণ হ্রাসে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা আর্থিক ন্যায্যতা ও টেকসই উন্নয়নের দিকেও ধাবিত হচ্ছে। এই সূচকটি চূড়ান্ত হলে তা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত দেশগুলোর জন্য একটি পরিষ্কার বার্তা দেবে যে, জলবায় পরিবর্তন মোকাবিলায় দেওয়া অর্থকে আর 'সহায়তা' হিসেবে গণ্য না করে, এটিকে ঐতিহাসিক ঋণ পরিশোধের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। কার্যকর ও ন্যায্য কার্বন বাজার এবং ঋণমুক্ত সবুজ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সঠিক ডেটা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করাই এখন COP30-এর সবচেয়ে বড় দাবি।

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার আর্টিকেল ৬ অব প্যারিস চুক্তি- নিঃসরণ হ্রাসের পথনির্দেশনা: কার্বন বাজারে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সবুজ উন্নয়ন নিশ্চিত করার দাবি শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেশনটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল- কার্বন বাজারে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং সবুজ উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিঃসরণ হ্রাসের পথনির্দেশনা।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাবিদ শফিউপ্লাহর সভাপতিত্বে উক্ত সেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়াউল হকের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরিদা আখতার বলেন,সমন্বিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশ তার নিজস্ব সক্ষমতা ও বৈশ্বিক অংশীদারদের সহায়তায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় এগিয়ে যাবে- এ বিষয়ে আমি আশাবাদী।

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন,বাংলাদেশের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বর্তমানে প্রায় 90–98 মিলিয়ন টন CO₂ সমতুল্য (২০২২), যা বৈশ্বিক নিঃসরণের মাত্র ০.৩৮ শতাংশ। সেক্টরভিত্তিকভাবে শক্তি খাত ৪৬ শতাংশ, কৃষি ৩৯ শতাংশ, শিল্প ৮ শতাংশ এবং বর্জ্য খাত ৭ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী। ২০২২ সালের বেস্ট ইয়ার অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট GHG নিঃসরণ ছিল ২৫২ মিলিয়ন টন CO₂e, যার মধ্যে শক্তি খাত ৪৮.৮১ শতাংশ, কৃষি, বন ও ভূমি ব্যবহার (AFOLU) ৩৭.৮৩ শতাংশ, এবং বর্জ্য খাত ১০.৬৯ শতাংশ অবদান রাখে। ২০৩৫ সালের NDC ৩.০ লক্ষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে ১৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি আরও বলেন,আর্টিকেল ৬ বাংলাদেশের জন্য নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র নির্গমন হ্রাসের কাঠামো নয়, বরং আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারে অংশগ্রহণের একটি কৌশলগত সুযোগ। তবে এই বাজারে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সবুজ উন্নয়ন অপরিহার্য।

সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ নাবিদ শফিউল্লাহ বলেন, Article ৬ দেশগুলোর মধ্যে নির্গমন বাণিজ্য, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও আর্থিক বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকসই পরিবহন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং কার্বন সংরক্ষণ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে।

প্যানেলিস্ট এর বক্তব্যে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ- এর কো-অর্ডিনেটর শরীফ জামিল বলেন, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল উভয় দেশেই স্থানীয় জনগণ ও নদী নির্ভর অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই আমাদের সবুজ উন্নয়ন হতে হবে জনগণকেন্দ্রিক, যাতে পরিবেশ, অর্থনীতি ও ন্যায্যতা সমান গুরুত্ব পায়। কার্বন বাজারে অংশগ্রহণ মানে শুধু আর্থিক সুবিধা নয়; এটি হতে হবে ন্যায্য, স্বচ্ছ ও টেকসই বৈশ্বিক চুক্তির অংশ।

প্যানেলিস্ট এর বক্তব্যে মিনিস্ট্রি অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ, সোমালিয়া- এর প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী আহমেদ বলেন, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি একসঙ্গে কাজ না করে, তবে বৈশ্বিক নিঃসরণ হ্রাস সম্ভব নয়। Article ৬ সেই যৌথ প্রচেষ্টার দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।