অবশেষে চট্টগ্রামে খাল সংস্কার ও পরিষ্কারকাজে গতি এসেছে। চট্টগ্রামের দুঃখ হিসাবে পরিচিত চাক্তাই খালসহ বেশ কয়েকটি বড় বড় খাল পরিষ্কার হয়েছে। কয়েকটি খালে নৌকাও চলছে। পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অংশ হিসাবে এসব খাল পরিষ্কার করা হচ্ছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গলদ থেকে যাওয়ায় দ্রুতই এসব খাল বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক খাল এখনো দখল আর আবর্জনামুক্ত হয়নি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওয়তায় ৩৬টি খালের সংস্কারকাজ চলছে। আরো ২১ খাল এই প্রকল্পের বাইরে থেকে গেছে। এসব খাল সংস্কারে সিটি কর্পোরেশন কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি। আবার নগরীর বেশিরভাগ ছোট ছোট খাল, ছড়া ও নালা-নর্দমা সংস্কারবিহীন থেকে গেছে। ফলে পানিবদ্ধতা নিরসনে সিডিএসহ চারটি সংস্থার নেয়া ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। ওই চারটি প্রকল্পে ইতেমাধ্যে আট হাজার ৩১২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এদিকে সরকারি তরফে মহানগরীর পানিবদ্ধতা নিরসনে নেয়া পদক্ষেপের ৮৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হওয়ার ফলে গেল বর্ষায় ৭৫ শতাংশ পানিবদ্ধতা নিরসন হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার অফিসে এক সভা থেকে আগামী ২০২৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগীর পানিবদ্ধতা পুরোপুরি সহনীয় মাত্রা চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।
পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রামের খাল, ছড়া নির্বিচারে দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নিন্মভূমি দখল, বেপরোয়া পাহাড় নিধনসহ নানা কারণে পানিবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। প্রতিবছর বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় নগরীর বিশাল এলাকা। নিয়মিত জোয়ারেও প্লাবিত হচ্ছে নগরীর বিরাট অংশ। প্রতিবছর বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যায় নগরী। পানিবদ্ধতায় শত শত কোটি টাকার ক্ষতি গুণতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
এই অবস্থা থেকে বন্দরনগরীকে মুক্তি দিতে বিগত সরকারের সময়ে চারটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পানিবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিনটি সংস্থা। এর মধ্যে সিডিএ দুটি, সিটি কর্পোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্পের কাজ করছে। প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে পাঁচ থেকে ১১ বছর ধরে। ইতিমধ্যে এসব প্রকল্পে খরচ হয়েছে আট হাজার ৩১২ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
পানিবদ্ধতা নিরসনে বড় প্রকল্পের আওয়তায় পানিবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে বহদ্দারহাট, ষোলশহর, বাকলিয়া, হালিশহর, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় খালের প্রশস্ততা বাড়ানো এবং নিকটবর্তি দুটি খালের মধ্যে নতুন সংযোগ দেয়াসহ প্রয়োজনীয় কাজ চলছে। কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত চাক্তাই, রাজখালী, মহেষখালসহ খালগুলোয় সুøইজ গেট নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খালের মুখে পাম্পও স্থাপন করা হচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় জোয়ারজনিত পানিবদ্ধতা সমস্যা আর থাকবে না। এসব খালের দুপাশে অনেক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোন কোন এলাকায় খালের পাড়ে সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। কোথাও আবার খাল পাড়ে হাঁটার পথ রাখা হয়েছে।
তবে এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কর্ণফুলীর নদীর অংশে খাল পরিস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ হলেও খালের অন্য অংশে দখলদার এবং আবর্জনার স্তপ এখনো রয়ে গেছে। ফলে খালের পরিস্কার অংশ আবার ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খালের মুখে সøুইজ গেট বসানোর জন্য সংস্কার ও পরিস্কার করা হয়েছে। কিন্তু যেসব শাখা খাল ও নালা-নর্দমা হয়েছে এসব খালে পানি প্রবাহিত হয় সে সব খাল-নালা ও ছোট খালে কোন সংস্কার কাজ করা হয়নি। এসব নালা-নর্দমায় আবর্জনা জমে ভরাট হয়েছে গেছে। আবর্জনার ওপর দিয়ে লোকজন হাঁটা চলা করছে। আবার সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গলদ থেকে যাওয়ায় নগরীর প্রতিদিনের আবর্জনা তথা বর্জ্যরে একটি বিরাট অংশ এসব খাল-নালা হয়ে বড় বড় খালে যাচ্ছে। তাতে আবারও এসব খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে চট্টগ্রাম মহানগীরর পানিবদ্ধতা নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকও বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের নদী খাল, নালাগুলোতে প্রতিদিন ৪০০ টন বর্জ্য জমা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ৩২০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিদিন ২৭০০ টন থেকে ২৮০০ টন বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হয়। বাকি বর্জ্য নালা-নর্দমা হয়ে খালে জমছে।
বৈঠকের পরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়-চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা নিরসনে যে বড় চারটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার ৮৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তাতে পানিবদ্ধতা ইতিমধ্যেই ৭৫ শতাংশ নিরসন করা সম্ভব হয়েছে।
সভায় উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগীর ২০২৩ সালে ১১৩টি স্পটে ৮ ঘণ্টা পানিবদ্ধতা ছিল। ২০২৫ সালে এসে ২১টি স্পটে পানিবদ্ধতা দুই থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আগামী বছর পানিবদ্ধতাপ্রবণ জায়গার সংখ্যা ১০টিতে নেমে আসবে এবং ২০২৭ সালে মহানগরীর পানিবদ্ধতা পুরোপুরি সহনীয় মাত্রা চলে আসবে বলে প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়।
গেল বর্ষার আগেই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় চট্টগ্রামে ৫ জন উপদেষ্টা একাধিকার পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সভা করেন। তাদের তদারকির সাথে বিএনপি ও জামায়াতও খাল সংস্কার কাজে যোগ দেয়। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএসহ সব সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টায় গত বর্ষায় নগরীতে পানিবদ্ধতার সমস্য তেমন প্রকট হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গেল বর্ষায় সরকারের কঠোর নজরদারি কারণে খাল-নালা দ্রুত পরিস্কার করা হয়। তার সুফলও পাওয়া গেছে। তবে নগরীর সবকটি খাল, ছড়া দখল ও দূষণমুক্ত করা না গেলে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গলদ সরানো না গেলে এসব প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল পাবে না নগরবাসী। তাছাড়া পাহাড় নিধনও বন্ধ করতে হবে। পলিথিনের কারণে খাল-নালা দ্রুত ভরাট হচ্ছে। পলিথিনের ব্যবহারও কমাতে হবে। এর পাশপাশি নগরীর খাল, নালা-নর্দমা সংস্কার করে নিয়মিত পরিস্কারকাজ অব্যাহত রাখতে হবে।