মস্কোতে অবস্থিত চীনা কোম্পানিতে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রাশিয়ায় মানব পাচার করছে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র। দুবাই, সৌদি আরব ও তুরস্ক হয়ে কর্মীদের পাঠানো হয় রাশিয়ায়। এরপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়। অনুমোদনহীন কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে চলছে এসব মানব পাচার। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে এসব এজেন্সি নিয়োগ দিয়েছে চীনা প্রশিক্ষক, দেওয়া হয় ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ও অ্যাপ্রুভাল লেটার। এভাবেই তরুণদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিচ্ছে এ সংঘবদ্ধ চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, চার ধাপে রাশিয়ায় মানব পাচার করছে চক্রগুলো। বিদেশে চাকরির কথা বলে প্রথমে লোক বাছাই করা হয়। সে ক্ষেত্রে ২৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির অধিক উচ্চতার যুবকদের টার্গেট করা হয়। রাশিয়ায় অবস্থিত চীনা কোম্পানিতে চাকরির কথা বলে তারা লোক সংগ্রহ করে। এরপর বাছাই কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আস্থা অর্জনের জন্য নিয়োগ করা হয় চীনা প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষণ শেষে চীনা কর্মকর্তারা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে লোক বাছাই করেন। বাছাই কর্মীদের নিয়োগপত্র ও অ্যাপ্রুভাল লেটার দেয় চীনা কোম্পানিগুলো। পুরো প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পন্ন করা হয় যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। তৃতীয় ধাপে চূড়ান্ত বাছাই কর্মীদের ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই, সৌদি আরব ও তুরস্ক হয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হয়। প্রলোভনে রাজি না হলে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।
এ সূত্র ধরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ফ্রেন্ডস অ্যান্ড কোঅপারেশন (এফসি) সেন্টার নামে অনুমোদনহীন এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, রাশিয়ায় পাঠানোর জন্য বাছাই তরুণদের নির্মাণকাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েক শিফটে ৮০ থেকে ১২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব কর্মীর প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছেন দুজন চীনা প্রশিক্ষক। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দেয়ালে বিভিন্ন চীনা কোম্পানির লোগো ও চীনা ভাষায় লেখা পোস্টার সাঁটানো রয়েছে।
রাশিয়া যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. হাসানের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। মো. হাসান জানান, ‘রাশিয়ায় নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে উইসন গ্রুপ, সিনোপেক, সেপকো-৩, পাওয়ার চায়না ও সিসিসি। কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য তারা এখানে নিজস্ব প্রশিক্ষক রেখেছে। কোম্পানিগুলোই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মীদের রাশিয়ার ভিসা প্রস্তুত করে দেয়। প্রশিক্ষণ, ভিসা প্রসেস প্রক্রিয়া, বিমান টিকিটসহ প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে আমরা ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে থাকি।’
প্রকাশ্য দিবালোকে রাশিয়ায় কর্মী পাঠানোর মহাযজ্ঞ পরিচালনা করলেও এফসি সেন্টারের কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো অনুমোদিত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়ও নেই প্রতিষ্ঠানটির নাম। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন ড. বরুণ ও ইমরুল কায়েস নামে দুই ব্যক্তি। এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ভুয়া কোম্পানি ও ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করে রাশিয়ায় মানব পাচারের অভিযোগ রয়েছে টু স্টোন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ও ড্রিম হোম ট্রাভেলের বিরুদ্ধে। এ দুই প্রতিষ্ঠানেরও কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। গত দুই বছরে ড্রিম হোম ট্রাভেল ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে ২০ জনকে রাশিয়ায় পাচার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ। সেলসম্যান, সিকিউরিটি গার্ড, ক্লিনার ও রেস্টুরেন্টে শেফের চাকরির কথা বলে রাশিয়ায় মানব পাচার করছে এ চক্র।
আসাদুজ্জামান নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ‘রাশিয়ায় ক্লিনার পদে চাকরির জন্য গত মে মাসে টু স্টোন টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে ৮ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। ভিসা প্রসেস করে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে তারা রাশিয়ায় পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে আমার বন্ধুও ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে এবং প্রাথমিকভাবে আমরা জনপ্রতি ১ লাখ টাকা করে তাদের দিই। এক মাস পর তারা আমাদের ওয়ার্ক পারমিট দেয়। রাশিয়া দূতাবাসে ওয়ার্ক পারমিট যাচাই করতে গেলে তারা ভুয়া বলে বাতিল করে দেয়।’
অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে বিদেশে কর্মী পাঠানোর অভিযোগ নতুন নয়। এর ফলে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে রাশিয়ার বিষয়টি ভিন্ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে ভুয়া কাগজ ব্যবহার করে কর্মী পাঠানো মানব পাচারের শামিল। এর ফলে কর্মীরা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতির মুখে পড়ছেন না, বরং তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনমৃত্যুর শঙ্কার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাশিয়ায় মানব পাচার নিয়ে অসংখ্য পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। কিছু মৃত্যুর খবরও পেয়েছি। মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরির প্রলোভনে পড়েই মূলত তারা পাচারকারী চক্রে ফাঁদে পা দেয়। এটা থেকে উত্তরণে সচেতনতার বিকল্প নেই। পাশাপাশি এ মুহূর্তে সরকারের উচিত রাশিয়ায় যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া বন্ধ করা।’