Image description
চার প্রশ্নের এক ব্যালটকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশ্লেষকরা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যে চার প্রশ্নে গণভোটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া নোট অব ডিসেন্টসহ রয়েছে ঐকমত্য হওয়া ইস্যুগুলোও। ভোটে হ্যাঁ জিতলে আগামী সংসদের সদস্য নিয়ে গঠিতব্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ ১৮০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। আর না জিতলে বাতিল হয়ে যাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা দলগুলোর অঙ্গীকার। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো।

সংক্ষেপে চারটি প্রশ্ন থাকলেও প্রতিটি প্রশ্নে রয়েছে বিস্তারিত অনেক বিষয়। এসব বিষয়ে জনগণকে জানানো ও ভোটে উদ্বুদ্ধ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় ওই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে মন্তব্য তাঁদের। সংশ্লিষ্টরা জানান, গণভোটের জন্য এখন প্রয়োজন জনগণকে সচেতন করা। এ ক্ষেত্রে সরকার ও দলগুলোকে যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে সরকার প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছে। আবার যেসব প্রশ্নের ওপর গণভোট আয়োজন করা হচ্ছে সেটাও সরকারের তৈরি। এ ক্ষেত্রে গণভোট বিষয়ে কীভাবে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা যায় সরকারকে সে পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যদিকে সনদের ইস্যুগুলো নিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। আগামী নির্বাচনে যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, সনদ বাস্তবায়নে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেদিক থেকে সনদ নিয়ে দলগুলোরও দায় ব্যাপক। সরকারসংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, খুব শিগগিরই গণভোটের প্রশ্নগুলো নিয়ে লিফলেট, পোস্টার ছাপানো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রচারকাজে লাগানো হতে পারে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করাই এর লক্ষ্য। পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক ফ্ল্যাটফর্মেও সরব ভূমিকা পালনের চেষ্টা করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে।

গণভোটের প্রশ্নকে জনগণের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে কতটা আন্তরিকভাবে নিচ্ছে, দ্বিতীয়ত সনদ নিয়ে নেতারা জনগণের মাঝে কেমন প্রচার চালাচ্ছেন, সর্বশেষ নাগরিকদের কাছে প্রশ্নগুলো বোধগম্য করতে সরকার কী ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এসব চ্যালেঞ্জ পার হতে না পারলে বা প্রশ্ন না বুঝলে জনসাধারণ কিন্তু গণভোটে আগ্রহী হবে না। কারণ সরকার এরই মধ্যে প্রশ্নগুলো জটিল ও কঠিন আকারে উপস্থাপন করেছে। প্রতিটি প্রশ্নের ভিতরে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটাকে আরও সহজ করলে ভালো হতো।’

এদিকে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সমাজমাধ্যমে গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে চলছে নানান ধরনের আলোচনা। ভোট পদ্ধতি ও প্রশ্ন বাছাই নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর বিএনপি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে দলটি জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা প্রতিপালনে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ। এর বাইরে চাপিয়ে দেওয়া, জবরদস্তিমূলক কোনো প্রস্তাব যদি দেওয়া হয়, তা জনগণ বিবেচনা করবে। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে একটি দলের স্বার্থে।’ এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে একমত নয় জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল। তারা নির্বাচনের আগেই গণভোট চেয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একাধিক নেতা বলেছেন, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশ জারি করার বিষয়টি তাঁরা মানতে পারছেন না। তবে অন্যান্য বিষয়ে আপত্তি নেই। এনসিপি আদেশ মেনে নেবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। গণভোটের দিন এ চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবে। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে প্রশ্ন পড়ে শোনান। তিনি বলেন, প্রশ্নটি হবে এ রকম-‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার-সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’ ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণভোটের দিন এ চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।