মালয়েশিয়া ফেরত বন্ধু জরেজ মিয়ার সঙ্গে গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছিলেন আশরাফুল হক। ঢাকায় আসার পর তার স্ত্রী একাধিকবার ফোন করেছিলেন স্বামীকে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন রিসিভ করেছিলেন জরেজ মিয়া। স্বামীর কথা জানতে চাইলে জরেজ মিয়া প্রতিউত্তরে জানিয়েছিলেন আশরাফুল জরুরি কাজে ব্যস্ত। এদিকে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় গতকাল শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, নিহত আশরাফুল রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি হিলি বর্ডারে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা পেঁয়াজ ও আলুর ব্যবসা করতেন। সরকারি লাইসেন্সও আছে তার। সম্প্রতি জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য গত মঙ্গলবার দুপুরে ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করতে বদরগঞ্জের গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদে যান তিনি। ওই দিন সন্ধ্যায় স্থানীয় মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে রেখে হঠাৎ মালয়েশিয়া ফেরত বন্ধু জরেজ মিয়ার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর থেকেই তার সঙ্গে আর তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি স্ত্রী লাকী বেগম। আশরাফুল ঢাকায় আসার একদিন পর থেকে স্ত্রী যতবারই ফোন করেছেন, ততবারই তার বন্ধু জরেজ ফোন রিসিভ করে বলেছেনÑ আশরাফুল ব্যস্ত আছে, পরে কথা বলবে। কিন্তু আশরাফুলের সঙ্গে আর সেই কথা বলা হয়নি স্ত্রী লাকী বেগমের। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হাইকোর্ট মোড়ে জাতীয় ঈদগাহের সামনে ফেলে যাওয়া দুটি প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে আশরাফুলের ২৬ টুকরো করা খ-িত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহত আশরাফুলের শ্যালক আব্দুল মজিদ বলেন, বুধবার বিকাল ৫টায় আশরাফুলের সঙ্গে আমার বোনের শেষ কথা হয়। শেষ কথায় বাবা মো. আব্দুর রশিদকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা বলেন আশরাফুল। এরপর থেকে আশরাফুলকে কল দিলে প্রতিবারই তার বন্ধু জরেজ ধরে। আর বলে, আশরাফুল ব্যস্ত আছে। বৃহস্পতিবার দুপুরেও আমার বোন লাকী বেগম দুলাভাইয়ের ফোনে কল করে। তখনো জরেজই ফোন রিসিভ করে। কিন্তু সে কোনোভাবেই আশরাফুলকে ফোনটি দিচ্ছিল না। এ জন্য আমার বোন জরেজের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিষয়টি জানায়। তখন জরেজের স্ত্রী তাকে ফোন দিলে জরেজ তার স্ত্রীকে বলেÑ আশরাফুলের ফোন নাকি সে ড্রেনে কুড়িয়ে পেয়েছে। এরপর রাতে আমি ও আমার বোন আশরাফুলের খোঁজে বদরগঞ্জ থানায় জিডি করতে গেলে, থানা থেকে বলেÑ আশরাফুলকে খুন করা হয়েছে। তার লাশ ঢাকায় হাইকোর্টের সামনে পাওয়া গেছে। এ কথা শোনার পর আমার বোন পাগলের মতো হয়ে গেছে। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই মাথায় আসছে না। পরে পুলিশ আমাদেরকে ঢাকার শাহবাগ থানায় আসতে বলেন।
তিনি বলেন, আশরাফুল সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কখনো কারোর ক্ষতি করেনি। তার বন্ধু জরেজ মিয়া পাশের শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থাকার পর সম্প্রতি দেশে ফিরে আসেন জরেজ। দেশে আশার পর আশরাফুলের সঙ্গেই বেশি চলাফেরা ছিল তার। আশরাফুলের কাছে টাকাও ধার চেয়েছিলো জরেজ। এরপরই তার সঙ্গেই ঢাকা আসে আশরাফুল। এখন তার লাশ পাওয়া গেল। শ্যালক আব্দুল মজিদ বলেন, হত্যার পরও সে নিস্তার পাইনি। তার লাশ ২৬টি টুকরা করা হয়েছে। যা কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব না। আমরা এই হত্যাকা-ের বিচার চাই।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মনসুর বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে কে বা কারা ভ্যানে করে এই ড্রামভর্তি লাশ হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হাইকোর্ট এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি থাকায় ভয়ে ড্রাম দু’টো জাতীয় ঈদগাহের সামনের রাস্তায় ফেলে চলে যায়। দুপুর ২টার পর থেকে ড্রাম দু’টি ওখানেই মেইন রাস্তার পাশে একটি গাছের গোড়ায় রাখা ছিল। এরপর সন্ধ্যায় আমাদের কাছে খবর এলে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ড্রাম দু’টি খুলে দেখিÑ ভেতরে টুকরো টুকরো মানুষের লাশ। লাশের গলা থেকে পা পর্যন্ত সবকিছুই আলাদা করা। প্রথমে লাশের পরিচয় জানা না গেলেও রাত সাড়ে ৭টার দিকে সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় শনাক্ত করে।
এ ঘটনায় শুক্রবার নিহতের ছোট বোন মোছা. আনজিরা বেগম বাদী হয়ে আশরাফুলের বন্ধু জরেজকে প্রধান আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, আমরা ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করছি। হত্যাকা-ের ঘটনার তদন্ত চলছে এবং আসামিকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আশা করছি, কারা কীভাবে তাকে হত্যা করে জাতীয় ঈদগাহের সামনের সড়কে রেখে গেছে তা সবই বেরিয়ে আসবে।