Image description

গণভোট নিয়ে গোলকধাঁধা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব, মতভেদ-বিভেদের মধ্যেই দেশজুড়ে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, সিপিবি, গণঅধিকার পরিষদসহ সব রাজনৈতিক দল এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচন করার সুযোগ পাবে কি-না সংশয় থাকার পরও জাতীয় পার্টিও নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেছে। এমনকি সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে নাÑ প্রধান উপদেষ্টার এমন বার্তার পরও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ অনুসারী আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। বিএনপি, জামায়াতের ঘোষিত প্রার্থী নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় বাড়িয়ে দিয়েছেন জনসংযোগ।

নির্বাচনী প্রচারণায় হচ্ছে শোভাযাত্রা, চলছে মোটরসাইকেল ও গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে একই দৃশ্য প্রতিদিন চোখে পড়ছে। গতকালও ঢাকায় কয়েকটি সংসদীয় আসনে প্রার্থীরা নির্বাচনী মিছিল করেছেন। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারণা চালাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার শঙ্কা প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা ইস্যুতে ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা হলেও সম্ভাব্য প্রার্থী ও সাধারণ মানুষ ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন। ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হবে’ বার্তার পর নির্বাচনী ট্রেন যেন দ্রুত বেগে চলতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে জনমত গঠন এবং বাড়তি সুবিধা আদায়ে কৌশল করছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল ‘আন্দোলন আন্দোলন খেলা’ করলেও কার্যত এগুলো দলটির নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা আদায়ের কৌশল। জামায়াতের শীর্ষ নেতারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচন ইস্যুতে আন্দোলনের কথা বললেও ৩০০ আসনে ঘোষিত দাঁড়িপাল্লার প্রার্থী ও দলের স্থানীয় নেতারা পিছিয়ে নেই নির্বাচনী প্রচারে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জোরদার করেছে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি। ইনকিলাবের উপজেলা-জেলা, আঞ্চলিক ও ব্যুরো প্রতিনিধিরা জানান, গ্রামের হাট-বাজার থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং চরাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। পোস্টারে-পোস্টারে ছেয়ে গেছে। গতকালও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের এই মুহূর্তের প্রধান চাহিদা একটি উৎসবমুখর নির্বাচন। বাংলাদেশের মানুষ এখন সেই অপেক্ষায় আছে, অন্য কোনো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমরা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাই, দেশের মানুষের মালিকানা ফিরিয়ে দেই।’ তবে গতকাল আটটি দলের সমন্বয়ে জামায়াত জোট সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে একমত নয় জামায়াতসহ আট দল। জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দাবি করে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘১৬ নভেম্বর আট দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হবে। সেখান থেকে নতুন কর্মসূচি আসবে।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলোÑ ভিন্ন ভিন্ন দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ঘোষণা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টাকে অপসারণ।

প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের পরও জামায়াতের আন্দোলন কৌশলকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতার পঙক্তির সঙ্গে তুলনা করছেন। কবিতাটি হচ্ছেÑ ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে’। এই পঙক্তির মাধ্যমে কবি মানুষের অতৃপ্তি, অস্থিরতা এবং নতুন কোনো গন্তব্যের খোঁজে থাকা এক আকুলতাকে বুঝিয়েছেন। ইতিহাসের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা জামায়াত ‘অন্য কিছুই’ প্রত্যাশা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং কয়েকজন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের আগে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। দলটির প্রার্থীরা সবার আগে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। তারপরও গণভোট ইস্যুতে জামায়াত হাঙ্কিপাঙ্কি করছে। কারণ হচ্ছে, পর্দার আড়ালে বিএনপির সঙ্গে ‘আসন সমঝোতা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াতের ব্যাপক প্রচারণা এবং জনসমর্থন প্রচার করা হলেও মাঠের চিত্র একেবারে ভিন্ন। যার জন্য জামায়াত ‘বলাকা’ কবিতার মতো পর্দার আড়ালে আসন সমঝোতা সুবিধা চায়। কারণ প্রচারণা ব্যাপক কলেবরে হলেও জনসমর্থনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে স্বাধীনতা-বিরোধিতা করা রাজনৈতিক শক্তি জামায়াত। এরশাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ’৮৬ নির্বাচনে জামায়াত ১০টি আসন পেয়েছিল। ’৯১ সালে বিএনপির অনুকম্পায় জামায়াত পায় ১৭টি আসন। ’৯৬ সালে এককভাবে ভোট করে পেয়েছিল তিনটি আসন। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে পেয়েছিল ১৮ আসন। আর ২০০৮ সালে জামায়াত পেয়েছিল দুটি আসন। নির্বাচনে বিএনপির সমর্থনে জামায়াতের অবস্থা একেবারেই খারাপ। অথচ হাসিনার অলিগার্ক জাতীয় পার্টির অবস্থান অনেক ভালো। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জামায়াতের বিরোধী দল হওয়াই কঠিন; অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় জামায়াত এমন আওয়াজ তুলছে যে, নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় যাবে। মাঠের অবস্থা একেবারেই খারাপ। যার জন্য পর্দার আড়ালে বিএনপির কাছে কিছু আসন চায় যাতে ওইসব আসনে বিএনপি দুর্বল প্রার্থী দিয়ে জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের নির্বাচিত হয়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ১৫ বছর ধরে জুলুম-নির্যাতনের শিকার বিএনপি এবার নেতাকর্মীদের চাপেই আসন সমঝোতার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ। যার জন্য গণভোট নিয়ে এমন হাঙ্কিপাঙ্কি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর-রহমান তার ইউটিউব চ্যানেল জাহিদ টকস এ বলেছেন, ‘জামায়াতের এবার ব্যাপক ভোট বাড়বে। অতীতে যে আসনে দাঁড়িপাল্লার প্রার্থীরা ২০ হাজার ভোট পেয়েছেন এবার সে আসনে হয়তো ৪০ থেকে ৫০ হাজার ভোট পাবেন। জামায়াতের জনসমর্থন বাড়লেও ওইসব আসনে ধানের শীষের প্রার্থীরা এক লাখ, দেড় লাখ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হবেন। এ বাস্তবতা বুঝেই জামায়াত পর্দার আড়ালে আসন সমঝোতা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’ এনসিপিকে নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছেন জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়ক আবদুল কাদের। হাসিনা-বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে এবং যখন ছাত্রনেতা নাহিদ-আসিফদের গ্রেফতার করে ডিবি অফিসে জোর করে আন্দোলন বন্ধের বিবৃতি আদায় করা হয়; তখন টেলিফোনে ছাত্রদের ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান যাত্রাবাড়ীতে রাজপথে নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল কাদের। ছাত্রনেতা এই আবদুল কাদেরের দৃঢ়তার কারণে ছাত্র আন্দোলনে গতি অব্যাহত থাকে। তিনি জামায়াতের কৌশলের পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের কৌশল নিয়েও মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এনসিপি নেতারা দিনে আন্দোলন করছে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছে অথচ রাতে বিএনপির নেতাদের বাসায় গিয়ে ২০টি আসনের জন্য ধর্ণা দিচ্ছে। বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের বাসায় তিনবার এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় এক রাতে এনসিপি নেতারা গেছেন’ ফেসবুকে স্ট্রাটাস দিয়ে দেশবাসীকে জানান। 

১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে একই দিনে। চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। আমাদের একটি গুরুদায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমি ঘোষণা করেছি, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।’ একই দিন যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারোনেস জেনি চ্যাপম্যান যমুনায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক এ নির্বাচনে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কার্যক্রম স্থগিত থাকা এবং নিবন্ধন বাতিল (স্থগিত) করায় আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না।’

সারাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার চিত্রের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ পর এখন আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নির্বাচনী প্রচারে মাঠ গরম। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণার আগেই বিভিন্ন দলের ঘোষিত এবং সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশজুড়ে সর্বত্রই এখন নির্বাচনের ডামাডোল। জেলা-উপজেলা, পৌরসভা ও গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারগুলোয় দিনভর নির্বাচনী আবহ; হাট-বাজারের চায়ের দোকানে ‘ভোটের চা’ বিতরণ চলছে। বিভিন্ন দলের প্রার্থী ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ছোট ছোট ‘উঠান বৈঠক’ করছেন, যেখানে স্থানীয় সমস্যা শুনছেন এবং তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কেউ কেউ অগ্রিম আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। ক্লাব-পাঠাগারগুলো তরুণদের যাতায়াত বেড়েছে। গণসংযোগের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের পরিচিতি বাড়াচ্ছেন এবং এলাকার মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করছেন। আবার বিএনপিসহ যেসব দলের এক আসনে একাধিক নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও গ্রুপিং নিরসনে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছেন। এবার হাটে-মাঠে-ঘাটে প্রথাগত প্রচারের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াও হয়ে উঠেছে নির্বাচনী প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে এবং দ্রুত বার্তা ছড়িয়ে দিতে অনেক প্রার্থী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণভোট ইস্যুতে বিতর্কের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। মানুষ যেভাবে নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছেন তাতে এ নির্বাচন দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে নিয়ে যাবে। এবারের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জন হবে চরম আত্মঘাতী।