Image description

দেশ থেকে ডলারের অস্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহ আবারও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়লেও নতুন অর্থবছরের শুরুতেই আমদানি ব্যয় দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অস্বাভাবিক প্রবাহের পেছনে অর্থপাচারের নতুন ধাক্কা কাজ করছে কিনা—তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন অর্থবছরের শুরুতেই বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি, চলতি হিসাবের ঘাটতি ফিরে আসা এবং ডলারের অস্বাভাবিক বহির্গমন—সব কিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি বাড়লেও যদি অর্থপাচারের মাধ্যমে ডলার বাইরে চলে যায়, তবে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

অর্থপাচারের শঙ্কা কেন বাড়ছে 

অর্থপাচারের শঙ্কা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি সমন্বিত কারণ কাজ করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক হারে ডলার বহির্গমন এবং আমদানি ব্যয়ের হঠাৎ বৃদ্ধি বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করেছে। পাশাপাশি ইনভয়েসিং প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিদেশে চিকিৎসা ও ভ্রমণ ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে— যা দেশ থেকে টাকা বের করে নেওয়ার পুরোনো পথগুলো আবার সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এসব কারণ মিলিয়েই সামগ্রিকভাবে অর্থপাচারের ঝুঁকি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

এক বছরে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৫ শতাংশ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়— চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭১ কোটি ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০৭ কোটি ডলার বেশি। অর্থাৎ এক বছরে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

এই সময় রফতানি আয় হয়েছে ১ হাজার ১০৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার, বিপরীতে আমদানি ব্যয় ১ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। রমজানকে ঘিরে খাদ্য, ভোজ্যতেল, চিনি ও নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত আমদানি—এবং একইসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি ডলারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। এতে দীর্ঘ সময় পর চলতি হিসাবও ঋণাত্মক হয়ে ৪৮ কোটি ডলার ঘাটতিতে নেমেছে।

ডলার কোথায় যাচ্ছে, প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় নয়, হঠাৎ ডলারের দ্রুত বহির্গমন স্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে অর্থপাচারের আংশিক ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “রেমিট্যান্স ও রফতানি প্রবাহ ইতিবাচক। তবু দেশ থেকে এত বেশি ডলার কোথায় যাচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। অস্বাভাবিক বহির্মুখী প্রবাহের মধ্যে অর্থপাচারের গন্ধ রয়েছে।”

তিনি মনে করেন, আমদানির কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হওয়ায় কিছু গোষ্ঠী সুযোগ নিচ্ছে এবং অতিরিক্ত ইনভয়েসিং বা ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার পাচার হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দেশে অর্থপাচার বন্ধ হয়নি, বরং যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারা এখনও অর্থ পাচার করছেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “অর্থপাচার আগেও হতো, এখনও হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধ হয়ে গেছে—এমনটা ভাবার কারণ নেই।” টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, “পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, সেই তুলনায় পাচার বন্ধ করার উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।’’ তিনি উল্লেখ করেন, এখন বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অর্থপাচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায়। প্রতিরোধই হতে হবে মূল লক্ষ্য।

রেমিট্যান্স বাড়ছে, বিনিয়োগে বিপরীত চিত্র

এ সময় প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৭.৫৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগও বেড়ে ৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় তিন গুণেরও বেশি। তবে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ উল্টো দিকে—গত বছর যেখানে নিট বিনিয়োগ ছিল ৫০ লাখ ডলার, এবার তা ঋণাত্মক ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা অনুভব করছেন, কিন্তু বিপরীতে দেশীয় কিছু গোষ্ঠী ডলার বাইরে পাঠাতে সক্ষম হচ্ছে—এই বৈপরীত্যই আর্থিক ব্যবস্থার ঝুঁকিগুলো তুলে ধরে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশ থেকে পাচার হওয়া মোট অর্থের প্রায় ৭৫ শতাংশই হচ্ছে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার বা ট্রেড-বেসড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০১৫ সালের অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধনের পর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর মোট ৯৫টি অর্থপাচারের ঘটনা তদন্তে নেয় এবং সব কয়টিই বাণিজ্যপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব ঘটনার আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রমজান ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “ডলার সংকট মোকাবিলায় আমরা কিছু নীতি শিথিল করেছি, যাতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে সমস্যা না হয়। আসন্ন পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এ কারণেই বাণিজ্য ঘাটতি বড় হয়েছে।” তবে তিনি অর্থপাচারের সম্ভাবনা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।

থামছে না অর্থপাচার

আর্থিক খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৬ বছরে দেশ থেকে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থের প্রবাহ থামেনি এখনো। বরং নতুন অর্থবছরের শুরুতে ডলারের অস্বাভাবিক বহির্গমন বৈদেশিক খাতে নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে।

শ্বেতপত্র কমিটির তথ্যে উঠে এসেছে—পাচার হওয়া অর্থের বড় অংশই গেছে বিভিন্ন ট্যাক্স হ্যাভেন দেশে। সেখানে অপরাধ চক্র বাড়ি কেনা, ব্যবসা স্থাপনসহ নানা ধরনের বিনিয়োগে এসব অর্থ ব্যবহার করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ দ্রুততর করেছে। এ জন্য দেশীয় সরকারি দফতরগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফার্ম, নজরদারি সংস্থা এবং আইনজীবী গোষ্ঠীর সঙ্গে লবিং চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘অন্তত দেড়শত ব্যক্তির বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করেছে, তাদের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি।” তিনি বলেন, “ব্যাংক থেকে ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাঠিয়েছেন। এসব লেনদেনও নজরদারিতে আছে।”

যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নতুন করে অর্থপাচার বন্ধ না হলে পুরোনো অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ অর্থহীন হয়ে পড়বে। জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন বলেন, “যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা বলে সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি সামনে আসে। তাই পুরোনো অর্থ উদ্ধারের চেয়ে এখনই পাচার বন্ধ করাই বেশি জরুরি।”

অর্থপাচার ঠেকাতে আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি

এদিকে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধে অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোকে আমদানি নীতি কঠোরভাবে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি পণ্যের মূল্য যাচাই এবং উচ্চমূল্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে নিয়ম মানতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি আমদানি মূল্যায়ন ও রিপোর্টিংয়ে বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত হওয়ার পর এক নীতিমালা পর্যালোচনা সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বেশ কিছু ব্যাংক ঋণপত্র খোলার সময় বা আমদানি চুক্তি করার সময় পণ্যের ঘোষিত মূল্য যথাযথভাবে যাচাই করছে না। এই অবহেলার কারণে অতিমূল্যায়ন (ওভার ইনভয়েসিং) ও অবমূল্যায়নের (আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমে অর্থপাচারের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে এক সার্কুলারে ব্যাংকগুলোকে এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘আমদানির যেকোনও নথি প্রক্রিয়াকরণের আগে ঘোষিত মূল্যের সত্যতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।’’

১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘‘বিদেশ থেকে আমদানিতে মূল্য বেশি বা কম দেখানো (ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং) এবং অর্থপাচার রোধে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে নতুন নিয়ম। প্রতিটি আমদানিতে স্বচ্ছতা, সঠিক মূল্য ঘোষণা ও নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক।

মূল নির্দেশনা

আমদানির মূল্য ও নথি যাচাই: এখন থেকে সব আমদানিতে বাণিজ্যিক নথি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নথি ওআইএমএস-এ রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক। ইনভয়েসে দেখানো মূল্য ও চুক্তি সংক্রান্ত তথ্য যথাযথভাবে যাচাই করতে হবে।

সতর্ক ও স্বচ্ছ নিরীক্ষণ: রফতানিকারক ও আমদানিকারক উভয়ের জন্য তথ্যভিত্তিক ও স্বচ্ছ নিরীক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংকের দায়িত্ব: ব্যাংকগুলোকে তাদের শাখা, ক্লায়েন্ট ও সংশ্লিষ্ট স্টাফদের এই নিয়ম সম্পর্কে অবিলম্বে জানাতে হবে। একইসঙ্গে ক্লায়েন্টদেরও নিয়মটি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

প্রস্তুতি ও প্রয়োগ: অনুমোদিত ব্যাংক-ডিলারদের (এডিএস) বিষয়টি সম্পর্কে প্রস্তুত থাকতে হবে। নিয়ম অমান্য করলে আমদানিতে বাধা পড়তে পারে বা নিরীক্ষণ আরও কঠোর হবে।