দেশে শ্রম রপ্তানি কমেছে। বৈশ্বিক শ্রমবাজারে গত এক বছরে জনবল রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তারপরও বাড়ছে রেমিট্যান্স। অবশ্য রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ-রেমিট্যান্স হয়ে ফিরছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করছেন অনেকেই। সিপিডিও এক গবেষণায় পাচার হওয়া অর্থ-রেমিট্যান্স হয়ে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছে। তথ্যমতে এক সময় দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসতো সৌদি আরব থেকে। বর্তমানে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ আগের বছরের তুলনায় কমেছে ২৩ শতাংশ। এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজার ৭২১ জন বিদেশে গেছেন।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছেন। তবে এই সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৩০% কম। ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮৯০ জন কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৯৭ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী বিদেশে যান। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৪৪২ জনে। অর্থাৎ চলমান বছরে জানুয়ারির তুলনায় কেবল ফেব্রুয়ারিতেই জনবল রপ্তানি কমেছে প্রায় ২০%। তথ্য বলছে, গত জুন মাসে ৯২ হাজার ২৩৬ জন, জুলাইয়ে ৬৩ হাজার ৫৪৭ জন, আগস্টে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪১২ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৮ হাজার ৯৮৬ জন, অক্টোবরে ৭৩ হাজার ৯৭৫ জন কর্মী বিদেশে গেছেন।
বাড়ছে চাপ: যেসব দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের বড় অংশ কাজ করে, সে বাজারগুলোয় সংকোচনের প্রবণতা পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় ৫৯ হাজার ৯০ জন কর্মী গেলেও ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন। ২০২৪ সালে তা কমে ৯৩ হাজার ৬৩২তে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০২২ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ জন, ২০২৩ সালে ৯৮ হাজার ৪২২ জন গিয়েছেন, ২০২৪ সালে ৪৭ হাজার ১৬৬ জন। ওমানেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ২০২২ সালে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬১২ জন গিয়েছিলেন, যা ২০২৩ সালে কমে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩-তে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে গেছেন মাত্র ৩৫৮ জন।
বিএমইটি’র গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মী রপ্তানিতে অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। এ সময়ে সর্বনিম্ন বছরে ৬ লাখ থেকে ১১ লাখ পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৫২৫, ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১, ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯, ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯, ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯, ২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন।
বিএমইটি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে, সংখ্যার দিক থেকে যা ৫০ লাখের বেশি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ লাখের মতো প্রবাসী কাজ করছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৮ লাখের মতো প্রবাসী অবস্থান করছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসীর সংখ্যা ১০ লাখের মতো। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখের বেশি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ১৬৮টিরও বেশি দেশে ১ কোটি ৩০ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে দেশে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে সংখ্যা নয় বরং বিবেচনা করতে হবে দক্ষতা। রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে ব্যবস্থা করতে হবে কর্মীদের জন্য বৈশ্বিক চাহিদানির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ।
বিএমইটি’র শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শ্রমবাজার বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি; নতুন নতুন বাজার খুলছি। এসব দেশের মধ্যে রাশিয়ায় বেশি কর্মী যাচ্ছে।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) এক নেতা বলেন, পুরো খাতে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির দায়ে পুরো খাত ভুগছে।
বায়রার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী বলেন, শ্রমবাজারের সংকট কাটাতে হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাজারগুলো দ্রুত খুলতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণে। অনেক কর্মী গিয়ে কাজ পাননি, ফলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারকে দ্রুত বিষয়টির সমাধান করতে হবে।
রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন: দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিট্যান্স। সংকটে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিচ্ছে রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ১০.৬৫ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইতিহাস গড়েছে রেমিট্যান্স। এই আর্থিক বছরে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ২৬.৮৩ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসের গড় হিসাবে এসেছিল ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ (২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। এই আর্থিক বছরের প্রথম তিন (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ (৭.৫৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫.৯০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬৫৪ কোটি ২০ লাখ (৬.৫৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
বছরভিত্তিক তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসে ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আসে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার।
রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বেড়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের প্রবাহের দেশভিত্তিক তথ্যে দেখা গেছে, রেমিট্যান্সের এই উৎস নিয়ে দেখা দিয়েছে আলোচনা। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল যে দেশ থেকে, সেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবার ধস নেমে প্রায় অর্ধেকে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য থেকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে গত দুই অর্থবছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল। এই দুই দেশকে ডিঙিয়ে আবার সেই সৌদি থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে; দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে যুক্তরাজ্য। শীর্ষ থেকে পাঁচে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র; আরব আমিরাত তৃতীয় স্থানে। মালয়েশিয়া চলে এসেছে চতুর্থ স্থানে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ১ হাজার ১৪ কোটি ৮৮ লাখ (১০.১৫ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.৫৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ১৬১ কোটি ৬৯ লাখ (১.৬২ বিলিয়ন) ডলার এসেছে সৌদি আরব থেকে। যুক্তরাজ্য থেকে ১২৮ কোটি ৭২ লাখ (১.২৯ বিলিয়ন) ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে এসেছে ৮১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। আমিরাত থেকে এসেছে ১১৮ কোটি ১৫ লাখ (১.১৮ বিলিয়ন) ডলার; কমেছে ১৩.৫০ শতাংশ। মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ১১০ কোটি ৩ লাখ (১.১০ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকগুলোকে যে দেশের রেমিট্যান্স, সেই দেশের আয় হিসাবে দেখানোর নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে কারণে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে।
পাচার অর্থ ফিরছে রেমিট্যান্স হয়ে: রেমিট্যান্সের গতি বেড়ে যাওয়া নিয়ে নানা মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই আগে পাচার করে নেয়া অর্থ এখন রেমিট্যান্সের নামে দেশে ফিরিয়ে আনছেন। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তারা নিচ্ছেন উচ্চ দরের পাশাপাশি আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা। এদিকে দুদকের এক মামলায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। দুর্নীতিবাজরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করে সেই টাকা আবার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ঢুকিয়ে সরকারের প্রণোদনার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই অপরাধীরা উল্টো রেমিট্যান্স যোদ্ধা বনে যাচ্ছে। এই তালিকায় আছেন- পতিত সরকারের সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও আমলারা।
সিপিডি’র প্রশ্ন: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য। রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের জায়গা দখলে নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এই দুই দেশ থেকে রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ব্যাখ্যা করে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে কিনাÑএ প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। ‘স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি’ প্রতিবেদনে রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্র তুলে ধরে সিপিডি।