জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনের জটিলতা অনেকটাই কেটে গেছে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে দলগুলো সরকারের প্রতি আস্থার কথা ব্যক্ত করেছে। তবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, রাষ্ট্রপতির বাস্তবায়ন আদেশ জারি নিয়ে সাংবিধানিক আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, সনদ নিয়ে জটিলতা কেটে গেলেও এখনো সাংবিধানিক জটিলতার আশঙ্কা বিদ্যমান। নোট অব ডিসেন্ট ক্লিয়ার করা হয়নি।
গণভোটে চারটি প্রস্তাবের ওপর একটি প্রশ্নে গণভোট হবে। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট ঘিরে আস্থা যেমন আছে, তেমনি সংকটের জায়গাও রয়েছে। সংকট উত্তরণের পথ খোঁজা শুরু হলেও সাংবিধানিক প্রশ্নগুলোর সমাধান এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। তবে সংকট উত্তরণের জন্য সরকারের এমন পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তারা। বিএনপি নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের বিষয়ে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দলটি বলছে, জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব যাতে খর্ব না হয়, সেজন্য আমরা কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, কোনো রকমের জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাই না। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দলটি বলছে, আদেশের কার্যকারিতার জন্য সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অপরিহার্য। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, অনেকগুলো বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। আদেশ জারি করা হলেও এমন কিছু জায়গায় অস্পষ্টতা রয়ে গেছে- এর দ্বারা জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা প্রশ্ন রয়েছে।
গতকাল এক সমাবেশে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মনে রাখতে হবে কেবল গণভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন কিংবা সংবিধান সংশোধন হয়ে যাবে না। এর জন্য জাতীয় সংসদ গঠিত হতে হবে। এটাই বাংলাদেশের একমাত্র সার্বভৌম হাউজ। যেখানকার কোনো আলাপ-আলোচনা, কার্যক্রম আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সময়ক্ষেপণ না করে আরও আগেই আদেশ জারি করা যেতো। তারপরও আদেশ জারির জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আদেশের কার্যকারিতার জন্য সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অপরিহার্য।
এসব বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন মানবজমিনকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলাম যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ প্রধান উপদেষ্টাকে জারি করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি- জুলাই সনদের যে আদেশ দেয়া হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ নিয়ে ¯পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য যে সাংবিধানিক বিষয়গুলো রয়েছে- সেগুলোর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে জুলাই সনদের আলোকে বাস্তবায়ন করা হবে। জুলাই সনদের যে সকল বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়ে গিয়েছে, সেগুলোতে কি নোট অব ডিসেন্ট সহকারে বা ছাড়া যাচ্ছে- এসব বিষয়ে আমরা স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাইনি। এ ছাড়া ৩০টির অধিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এগুলো পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে- যা আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণের মাধ্যমে সকল দলকে খুশি রাখতে চেষ্টা করেছেন। এ আদেশের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল তা উত্তরণের চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে চারটি বিষয়ে হ্যাঁ না ভোট দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। কেউ চারটি বিষয়ের মধ্যে দু’টি কিংবা একটিতে দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন, কাজেই এখানে একটি ব্যালটে উত্তর দেয়াটা জটিল।
তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে গণভোট করা হচ্ছে তা সফল হবে কিনা তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। সংবিধান সংশোধন আদেশ প্রেসিডেন্টের নামে জারি করা হয়েছে- তা এ সরকার করতে পারে না। এ ছাড়া আমরা যেভাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি সেগুলো সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। কোনো কোনো বিষয় সরকার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ বিদ্যমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এটি একটি পথ হতে পারে। সকল দলকে এটিকে মেনে নেয়া উচিত।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের বিষয়টিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে অনেকগুলো বিষয়ে যেখানে নোট অব ডিসেন্ট ছিল, সেগুলো স্পষ্ট করা হলো না। এ বিষয়ে একটি ধোঁয়াশা থেকেই গেল। গণভোটে চারটি বিষয়ে একটি প্রশ্ন থাকবে, এরমানে নোট অব ডিসেন্ট বিষয়ে কোনো সুরাহা করলেন না।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম মানবজমিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। সকল পক্ষের বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে তিনি একটি ভারসাম্যমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছি। তিনি বলেন, আশা করি এই বক্তব্যের মাধ্যমে সকল সংকটের সমাধান হবে। আমরা নির্বাচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু যারা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়, তাদের ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। তারা নানা অজুহাত তুলে সমস্যা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। নির্বাচনের দিন গণভোটকে আমরা সাধুবাদ জানাই। দ্বি-কক্ষ সংসদের বিষয়ে বিএনপি, এলডিপিসহ কয়েকটি দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এরপরও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এর আগেও আমরা দলের পক্ষ থেকেও বলেছি জুলাই সনদ নিয়ে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ও সরকার জুলাই সনদকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে- তাতে জুলাই সনদ কার্যকর করা নিয়ে তারা একটা অন্তরায় তৈরি করেছে। যেগুলো সংস্কার হওয়া দরকার সেগুলোতে আমরা একমত পোষণ করেছি। জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। আমরা বারবার বলেছি আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে তারা এ সংস্কারগুলো করবেন। জুলাই সনদ সংবিধানের ওপর দেয়া যায় না, সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। সংবিধান কখনো এ ধরনের আদেশ সমর্থন করে না। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া গণভোটের মাধ্যমে এ ধরনের সংস্কার করা সম্ভব নয়।