Image description
 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। এতে চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্ন থাকবে। মাত্র একটি প্রশ্নেই ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে মতামত জানাবেন। গণভোটের ফল ইতিবাচক হলে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতিতে) ১০০ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। একই সঙ্গে ১৮০ দিনের জন্য প্রস্তাবিত ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ দায়িত্ব পালন করবে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব তথ্য জানান।

 

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরপরই রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এ-সংক্রান্ত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারি করেন। পরে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির আগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।

 
 

এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার জন্য এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে দলগুলো সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার আগের ঘোষণার অংশ হিসেবে আদেশ জারি করে।

বিএনপির অভিযোগ আছে—জুলাই সনদে আলোচনা হয়নি, এমন বিষয়গুলো ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়ন আদেশের সুপারিশে এনেছে। আবার দলটির ‘নোট অব ডিসেন্টগুলো’ বাস্তবায়ন আদেশের সুপারিশে নেই। ঐকমত্য কমিশন সুপারিশে গণভোট অনুষ্ঠানের দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা সংসদ নির্বাচনের একই দিনে বা তার আগে গণভোট অনুষ্ঠানের সুপারিশ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ছিল—সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে হবে।

অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীর দাবি ছিল—সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে। এদিকে, বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে জোরালো আপত্তি জানাতে দেখা না গেলেও উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে জোর আপত্তি ছিল জামায়াতের। জামায়াতের দাবি, সংখ্যানুপাতিক ভোটের (পিআর) ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন হতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশেও জামায়াতের দাবির প্রতিফলন হয়েছে। তবে বিএনপির দাবি ছিল—বিদ্যামান সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতির আদলে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। এ কারণে ঐকমত্য কমিশনের ওই সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট আছে বিএনপির। গণভোটের প্রশ্নের একটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো আনা হলেও ব্যতিক্রম হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে।

গণভোটের প্রশ্নের ‘ঘ’ অংশে সামগ্রিকভাবে নোট অব ডিসেন্টকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও উচ্চকক্ষ গঠনের প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে আনা হয়েছে। এর ফলে গণভোটে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠান এবং উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি সমন্বয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ১৩ মিনিটের ওই ভাষণে গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। কমিশনগুলোর কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকার অধ্যাদেশ বা আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে সুশাসনের জন্য এসব সংস্কার বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। আশা করি আগামী নির্বাচিত সরকার সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ করবে। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারিতে উৎসবমুখর ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবের সমাধান হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। বাকি ১৮টি প্রস্তাবের ওপর দলগুলোর ভিন্নমত ছিল। ৩০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘটনাকে ঐতিহাসিক অর্জন বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।

দলগুলোর ভিন্নমতকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক নয় মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, কিছু প্রস্তাবে সামান্য ভিন্নমত আছে। তবে খতিয়ে দেখলে পাওয়া যায় যে, এসব প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও আসলে মতভিন্নতা খুব গভীর নয়। কেউ সংস্কারটা সংবিধানে করতে চেয়েছে, কেউ আইনের মাধ্যমে করতে চেয়েছে। কিন্তু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে কারো মধ্যে মতভেদ নেই। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য বক্তব্যে যতখানি পরস্পরবিরোধী অবস্থান আছে বলে মনে হয়, জুলাই সনদ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে ততখানি মতপার্থক্য দেখা যায় না। এটি আমাদের অনন্য অর্জন। এতে জাতি এগিয়ে যেতে সাহসী হবে।

গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না। নির্বাচন আরো উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।

 

গণভোটের প্রশ্নে যে চারটি বিষয় থাকবে

গণভোটের ব্যালটে চারটি বিষয়ে এক প্রশ্ন থাকবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। প্রশ্নগুলো হল—‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’

প্রথমত, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। তৃতীয়ত, সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। সর্বশেষ জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

ড. ইউনূস ভাষণে বলেন, গণভোটে চারটি বিষয়ের ওপর মাত্র একটি প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।

গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’ সূচক হলে আগামী সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সংবিধান সংস্কার শেষ হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের পিআরের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। এর মেয়াদ হবে নিম্নকক্ষের শেষ কার্যদিবস পর্যন্ত।

ড. ইউনূস বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটিও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দলীয় স্বার্থ অতিক্রম করে সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় চাওয়াকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ সিদ্ধান্ত জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে। এর মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করব। আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছলাম।’

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণকে পৃথিবীর জন্য উদাহরণ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এটি ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যও আশাব্যঞ্জক।

অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের সরকারের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব ছিল মূলত তিনটি। হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, একটি জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের আয়োজন করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ এগিয়ে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রথম রায় শিগগির দিতে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে আরো কয়েকটি মামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সাধারণ ফৌজদারি আদালতগুলোয়ও জুলাই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কিছু বিচারকাজ শুরু হয়েছে। আমরা একই সঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুমের মতো নৃশংস অপরাধের বিচারকাজ শুরু করেছি।’

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রিজার্ভসহ অর্থনীতির সবগুলো সূচকে দেশ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাত ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। ব্যাংকিং খাতকে আরো শক্তিশালী করতে নানামুখী পদক্ষেপ চলমান আছে।

আগামী সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে ৩০ বছরের জন্য ডেনমার্কভিত্তিক মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানটি ৫৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এটি এযাবৎকালে বাংলাদেশে ইউরোপের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ। লালদিয়া হবে দেশের প্রথম বিশ্বমানের গ্রিন পোর্ট।