Image description
 

মানুষ আকৃতি ও মস্তিষ্কের জটিল নার্ভ সিস্টেমে গঠিত এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে সেরা, যেখানে entrusted হয়েছে ন্যায়, করুণা ও সৌন্দর্যের নানা দিক। মানুষের স্বভাবসুলভ সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা এখন মানুষই যেন ভুলে গেছে। পৃথিবীর দিকে দিকে মানুষ এখন নিজের মিশন, নিজের কর্ম—সব ভুলে নির্দয় পাশবিক আচরণে মত্ত হয়ে উঠেছে। অযৌক্তিক চিন্তাচেতনায় উদ্ভূত ভুল পথ মাড়িয়ে ফেটে পড়ছে অট্টহাসিতে। পৃথিবীর এই চকমকে সভ্যতার আবরণে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ অন্ধকার, যার পরিণতি মনুষ্যত্বের করুণ পতন।

 

ইতিহাসের আয়নায় দেখা যায়, একসময় জাহেলি যুগের বেদুইনরা ছিল শক্তির অহংকারে উন্মত্ত। তাদের তরবারি ছিল ধারাল আর হৃদয় ছিল মরুর বালুর মতোই শুষ্ক। তারা গর্ব করত লুণ্ঠনে, আনন্দ পেত হত্যায়। দুর্বল মুসাফির যখন ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে মরুভূমি অতিক্রম করত, ঠিক তখন সেই পথিকের সওদা ছিনিয়ে নেওয়া ছিল তাদের কাছে বীরত্বের প্রতীক। সব হারিয়ে যারা অসহায় হতো তাদের কান্না ছিল বেদুইনদের বিনোদনের উপকরণ। কোরআন সেই অন্ধকার সময়কার ভয়াবহতা এঁকেছে এক আয়াতে—‘তোমরা এমন অবস্থায় ছিলে যে, একে অপরকে হত্যা করতে এবং তোমাদের গোষ্ঠী থেকে দুর্বলদের তাড়িয়ে দিতে।’ (সুরা আল-বাকারা : ৮৫)

 
 

এই অমানবিকতার আঁধারে উদিত হয়েছিলেন করুণা ও ন্যায়ের সূর্য, মুহাম্মাদ (সা.)। নবীজি মানুষকে শেখান, দয়াই মানবতার প্রাণস্পন্দন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।’ (বুখারি : ৬০১৩)। আরেক হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে মানুষের প্রতি রহম করে না, আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না।’ (মুসলিম: ২৩১৯)

তবুও আজ এই দুনিয়া যেন ফিরে গেছে সেই পুরোনো জাহেলিয়াতে। সভ্য পোশাকে আবৃত, কিন্তু অন্তরে মরুভূমির সেই নিঠুর শুষ্কতা। গত সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ল এক মর্মন্তুদ দৃশ্য—শীর্ণকায় এক কুলি নিজের প্রাপ্য মজুরি ফেরত পাওয়ার আশায় ট্রেনের সঙ্গে দৌড়াচ্ছেন । ঘামে ভেজা শরীর, হাঁপ ধরা বুক—তবুও চোখে এক অনড় দৃঢ়তা। তিনি চাইতে থাকলেন আর দৌড়ালেন। মজুরি দিল না বিবেকহীন ‘ভদ্রলোক’। ট্রেনের গতির কাছে পরাস্ত হয়ে শেষমেষ মজুরি না পেয়ে তিনি আহাজারি করলেন— ‘আল্লাহ, আপনার কঠিন বিচার করবেন!’

সেই পরিশ্রমী মানুষটির কণ্ঠে ক্ষোভ নয় ছিল এক আহত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস, যা বিনা নেটওয়ার্ক সংযোগে পৌঁছে গেছে আরশে আজিমে। এ ভিডিও দেখে আমি লজ্জিত হই—মানুষ এক কুলিকে প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করল? এ যেন আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে শ্রমিক দৌড়ায় ন্যায়ের পিছে, কিন্তু ন্যায় থামে না তার জন্য।

আগে দেখা যেত চোর-ডাকাতরা হারাম কাজ করলেও অসহায়, দরিদ্র ও নিঃস্বদের ওপর হামলা করত না। অথচ মনুষ্যত্বের পতন এত নিচে গিয়ে ঠেকেছে যে, সেদিন দেখা গেল, একটি এতিমখানায় হানা দিয়েছে একদল ডাকাত। এতিমকে ঠকাচ্ছে আপন চাচা-ফুপু; আর বিধবার পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের ইজ্জত হরণের ধান্দায় ঘুরছে একদল নেকড়ে!

মিডিয়ার আরেকটি দৃশ্য আমাদের চোখকে থামিয়ে দিয়েছে। শরীয়তপুরের নরিয়া উপজেলার মুতালেব নামের এক পরিশ্রমী ও দরিদ্র মানুষ। তার জীবনের একমাত্র উপার্জনের উৎস ছিল একটি গাড়ি । গত ৭ নভেম্বর দুর্বৃত্তরা সেই গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধোঁয়ার কালো ছায়ায় পুড়ে যায় সে জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ; আজ সেই পরিবার দাঁড়িয়ে আছে ছাইয়ের পাশে, হাত তুলে আসমানের দিকে তাকিয়ে বলছে—“হে আল্লাহ, কোথায় সেই মানুষগুলো, যারা একদিন ‘মানবতা’র নামে গর্ব করত?”

 

 

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন—‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সুরা আন-নিসা : ২৯)। আর নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! সে মুমিন নয়; আল্লাহর শপথ! সে মুমিন নয়; আল্লাহর শপথ! সে মুমিন নয়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কে সেই ব্যক্তি?’ তিনি বললেন, ‘যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বুখারি : ৫৬৭০)

আজ মানুষের হাতই মানুষের ভয়, যে হাত সাহায্য করতে না পারলে সমস্যাগ্রস্ত করার কথা নয়, সেই হাত আজ ছিনিয়ে নেয়; যে মুখ দিয়ে শান্তি ও সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করার কথা ছিল, সে মুখ আজ বিষাক্ত শব্দে চারপাশ নীল করে দিচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা বসবাস করছি, যেখানে অন্ধ ফকিরের কয়েকটা পয়সা পর্যন্ত পথিক কেড়ে নিচ্ছে নির্দয়ভাবে। এ দৃশ্যগুলো মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগায়, এ কেমন পতন? মূলত এই পতন কেবল নৈতিক নয়, বরং আত্মিকও।

যে মানুষ অন্যের প্রাপ্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আসলে নিজের রবের প্রতিও অকৃতজ্ঞ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ (মুসনাদ আহমাদ : ১৮৪৪৯)

মানুষের প্রতি অকৃতজ্ঞতা, অন্যায়ের প্রশ্রয় নিষ্ঠুরতার প্রশস্তি—প্রকৃতপক্ষে এসবই মনুষ্যত্বের কবর। আল্লাহ বলেন, ‘যে একটি প্রাণকে রক্ষা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করল।’ (সুরা আল-মায়িদা : ৩২)। বুখারির হাদিসে নবীজি বলেছেন, এক কুকুরকে পানি খাইয়ে এক ব্যভিচারী নারী জান্নাত লাভ করেন। পক্ষান্তরে একটি কুকুরকে বেঁধে রেখে অনাহারে মেরে ফেলায় এক ব্যক্তিকে জাহান্নামে দেওয়া হয়। তাহলে যে একটি প্রাণকে কষ্ট দেয়, একজনের জীবিকা ছিনিয়ে নেয়, সে যেন গোটা মানবতার বুকে বোমার আঘাত হানে।

এ কেমন মানবতা—যেখানে এক কুলি তার মজুরি পাওয়ার জন্য দৌড়ে ব্যর্থ হয়, যেখানে এক পরিশ্রমী মানুষ আগুনে হারায় তার জীবিকার অবলম্বন; অথচ অন্যায়ের বিচার করার জন্য মানুষ নামের একটা প্রাণী এসে সম্মুখে দাঁড়ায় না, এমনকি এ জুলুমের বিরুদ্ধে কথাও বলে না। বিশাল বিশাল অট্টালিকায় সুসজ্জিত হয়ে শহরগুলো গ্রামের বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে; আর এদিকে মানুষের অন্তরে পচে যাচ্ছে বিবেকের গাছপালা।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কেবল সঠিক তরবিয়ত তথা শিক্ষা ও আদর্শে প্রজন্ম গড়ে তোলা, যারা হবে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতে বাবা-মায়ের সম্পদ। আর মনুষ্যত্বের জাগরণ হবে সেদিন, যেদিন দয়া ও ভালোবাসা হবে ভদ্রতা ও সংস্কৃতির প্রতীক। যেদিন মানুষ শিখবে অন্যের দুঃখে কাঁদতে, যেদিন কৃতজ্ঞতা হবে জীবনের অলংকার, আর ইনসাফ হবে মানুষের প্রতিদিনের রুটিন ।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দয়া করো পৃথিবীর মানুষদের প্রতি, আসমানের মালিক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি: ১৯২৪)। তিনি শিখিয়েছেন—মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা ইবাদত, নম্র ভাষায় কথা বলা ইবাদত, চলার পথে অন্ধের হাত ধরা, বয়স্ক-অসুস্থকে বোঝা বহনে সহযোগিতা করা ইবাদত, পথহারাকে পথ দেখানো ইবাদত এবং জন ও মানবকল্যাণের প্রতিটি কাজই ইবাদত।

আজ আমাদের শিক্ষিতের হার বাড়ছে; কিন্তু উন্নত মূল্যবোধ ও কোমল হৃদয়সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কমছে। মার্জিত ব্যবহার ও আখলাক হারিয়ে মেকি ভদ্রতার দাপট প্রকট হয়ে উঠছে। ইসলামের সরল অকৃত্রিম আখলাকের শিক্ষা, প্রচার ও চর্চা ছাড়া এই সমাজকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই।

তাই প্রত্যাশা—আমাদের প্রজন্ম হবে আলোর পথিক, তাদের দ্বারা ইনসাফবেষ্টিত হবে পৃথিবীর অলিগলি। সেদিন ছায়াচ্ছন্ন সেই কুলির মুখে হাসি ফুটবে, নির্ভাবনায় পরিশ্রমের মূল্য পাবে সব শ্রমিক।