বাংলাদেশে নভেম্বর-২০২৫-এ যে অবস্থা চলছে, পরাজিত ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের যে প্রকাশ্য হুমকি, অপতৎপরতা এবং অন্তর্ঘাত চলছে, তাতে করে জনঐক্য ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা সর্বাধিক জরুরি। এই পরিস্থিতিতে জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনের আগেই গণভোট হবে কি নাÑএ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। গণভোটের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিল স্পষ্টতই। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দল এটাও মেনে নিয়েছে যে, ঐকমত্যের বিষয়াদি জনগণের চূড়ান্ত অভিপ্রায়, ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত ও রায়ের জন্য হাঁ-না-ভোটে দেওয়া হবে। গোড়াতে বিএনপি এটা নির্বাচনের পরে করার কথা বললেও পরে নির্বাচনের দিনই একযোগে সমাধা করার পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপির সম্ভাব্য নির্বাচনিজোট শরীকরাও এমনটা চায়। ওদিকে জামায়াতসহ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াধীন ইসলামি দলগুলো এবং অন্যান্য কিছু দল সাধারণ নির্বাচনের পূর্বেই গণভোট অনুষ্ঠান করে জনমত যাচাই করতে চায়। এনসিপিও খুব শক্তিশালীভাবে গণভোট চায়। তবে তারা নির্বাচনের আগে নাকি নির্বাচনের দিন গণভোট হবেÑএ ব্যাপারে একটু নমনীয় বা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে।
কতগুলো বিষয় এ থেকে স্পষ্ট। প্রথমত, গণভোট নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হলে দুটি একযোগে সমাধা করার এবং জনগণের দিক থেকে বোঝার ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কার্যত ফলপ্রসূ কিছু হবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ গণভোট গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, খরচের বিষয়টি নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি বলে বিবেচনা করা যায়। তৃতীয়ত, জনগণ গণভোট বুঝে না, এমন ব্যক্ত ধারণা জনবিচ্ছিন্ন ক্ষমতালাভেচ্ছু উপরতলার মুষ্টিমেয় এলিটবৃত্ত ও রাজনীতিবিদদের চাপিয়ে দেওয়া ধারণা। চতুর্থত, বিএনপি এখন যা বলছে, গণভোটকে দূরে ঠেলে দিতে, তা তাদের পূর্বেকার দলীয় সিদ্ধান্ত তথা ভিশন-২০৩০ এবং ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচির সম্পূর্ণ বিরোধী। ২০১২-১৩ সালে এই লেখক কর্তৃক বেগম খালেদা জিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদত্ত ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় একযোগে তৈরি করে দেওয়া গবেষণাপত্রে ‘রাষ্ট্র মেরামত’-এর পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচির ভলিয়্যুমদ্বয়েÑ‘ফরোয়ার্ডিংয়ে মেমো অন পলিসি পজিশন অব করাপশন ফর কনসিডারেশন অব বিএনপি পার্লামেন্টারি পার্টি ককাস’ শিরোনামায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাবতীয় মৌলিক রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন, সরকার পরিচালনা ও অন্যান্য বিষয়ের ব্যাপারে কনসেনসাস বা ঐকমত্যের চূড়ান্ত স্মারক নীতিমালা এবং আইনানুগ ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে গ্রহণীয় সিদ্ধান্তগুলোকে পূর্বাহ্ণেই গণভোটের মাধ্যমে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি সেটা গ্রহণ করে এবং ভিশন-২০৩০-এর গণতন্ত্র অংশের ৭ এবং ৮ নম্বর ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ৮ নম্বর ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, ‘বিএনপি সংবিধানে গণভোটব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করবে।’
এরপর ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পেরিয়ে ২০টি গবেষণা গ্রন্থ ও প্রিন্টেড ডকুমেন্ট বিএনপির কমপক্ষে ৩০ জন সর্বোচ্চ ৩০ নেতাকে দেওয়া হয়েছিল। তারা তা বুঝে স্ট্যান্ডিং কমিটির সিনিয়র এক সদস্য কর্তৃক তা থেকে ২৭টি পয়েন্ট তৈরি করেছিল, যা পরে ৩১ দফায় রূপ পায়। এ ক্ষেত্রে তারা স্পষ্টতই বাদ দেয় নৈতিকতা, ইসলাম ও মুসলিমের বিষয়াদি।
কিন্তু মূলকথা হচ্ছে, গণভোটের বিষয়টি রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান অত্যন্ত ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন জনমত ও জন-ইচ্ছা জেনে নেওয়ার জন্য। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তৎকালে সংবিধানে গণভোটের প্রভিশন না থাকা সত্ত্বেও দুটি প্রেসিডেনশিয়াল প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে নিজে নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেই, ১৯ দফার আগেই, নিজে প্রথমে জাগদল এবং পরে বিএনপি গঠনের পূর্বেই, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পূর্বেই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বেই দুটি প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ব্যাপক সংশোধন আনেন ও কার্যকর করেন। সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’সহ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬, ৮,৯, ১০, ১২, ২৫, ৪২, ৪৯ ও ৯৩ ইত্যাদির ক্ষেত্রে ১৯৭৭-এর ২২ এপ্রিলের ১ নম্বর প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সংশোধনকরত সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদকে একেবারেই বাতিল করে দিয়ে ১১-এর পর ১২-কে শূন্য রেখে তারকা চিহ্নিত করে বা নেই করে দিয়ে ১৩ অনুচ্ছেদ গোনার প্রমাণ রেখেছিলেন। এরপর ২৭ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে জানিয়ে প্রেসিডেনশিয়াল সেকেন্ড প্রক্লেমেশন অর্ডারের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪৪, ৭৪, ৯৩, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৬, ১১০ ও ১১৩ অনুচ্ছেদে ব্যাপক সংশোধন ও পরিবর্তন করে সেসব তৎক্ষণাৎ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। দুবছর পর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নেই অবস্থা থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নতুনভাবে গঠিত হওয়ার পর ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে পঞ্চম সংশোধনের মাধ্যমে উল্লিখিত সবকিছু একসঙ্গে একযোগে র্যাটিফাই করে নেওয়া হয়েছিল। অতি অবশ্যই সত্য যে, রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার এ কাজ খুবই ইতিবাচক অর্থে বাংলাদেশকে স্বাধীন, জনইচ্ছাসম্পন্ন, মানুষের অধিকারভিত্তিক, বহুদলীয়, সম্মতিনির্ভর ও আদালতের স্বাধীনতাভিত্তিক করতে সাহায্য করেছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সে সময় পর্যন্ত সংবিধানে গণভোটের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও জিয়া সংবিধানের পরিবর্তনগুলোকে সর্বোচ্চ বৈধতা দেওয়ার জন্য গণভোটকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑবিএনপি জিয়ার আদর্শের দল ও জিয়ার সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও এবং ভিশন-২০৩০ এবং পরবর্তীকালে ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচি গ্রহণ করার কালে সংবাদ সম্মেলনে গণভোটের ব্যবস্থা বিএনপি কর্তৃক গৃহীত হবে বলে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছিল।
বিএনপি রাষ্ট্রের জনমালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লিখিত ও ছাপাকৃত অঙ্গীকার সত্ত্বেও কেন আজ ১৯ দফা, ভিশন-২০৩০-কে সরিয়ে দিয়ে গণভোটকে সমস্যা সমাধানের এবং জনইচ্ছা ও জনরায় যাচাইয়ের বৈধ শর্ত হিসেবে গ্রহণ করতে গররাজি হচ্ছে? কেন তারা রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার দৃষ্টান্ত থেকে সরে গিয়ে বড়জোর নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করতেই শুধু সম্মত হচ্ছে?
এটা তো তাদের না বোঝার কথা না যে, গণভোটে জুলাই সনদের ঐকমত্যের বিষয়াদি কিছুটা সময় নিয়ে জনগণকে জানিয়ে-বুঝিয়ে তাদের মতামতের জন্য গণভোটে না দিলে পূর্বাহ্ণেই জনগণের ইচ্ছা ও ম্যানডেট জানা যাবে কী করে?
এখন তাদের কেউ কেউ এও বলছেন, জুলাই সনদের দরকার নেই। ঐকমত্য যা হয়েছে, তা নির্বাচিত হওয়ার পরই শুধু নতুন সরকার যারা হবে, তারা সংসদের মাধ্যমে ঠিক করবে করণীয়। তাহলে তো, আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে মূল ভিত্তিশর্ত তথা জনগণের ইচ্ছাই পূর্বাহ্ণে জানা হলো না। আর সমগ্র বিষয়টিও সর্বোচ্চ বৈধতা পেল না। সে ক্ষেত্রে তো বিষয়টি এই যে, তারা ঊনজন এলিট রাজনীতিবিদ ও প্রতিনিধিবর্গ, যা ঠিক করবেন, সেটাই চূড়ান্ত। জনগণ পূর্বের ন্যায় তাদের মালিকানাধীন রাষ্ট্রে বাস্তবে শুধু প্রজামাত্রই রয়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায়, ফ্যাসিবাদ বিতাড়নের এতবড় কাজ এবং এতদিনের ঐকমত্যের বাস্তব রূপ তো কেবল কতিপয়ের হাতেই রেখে দেওয়ার মতলবই টিকে যাচ্ছে। এসব মানবে কেন ছাত্র-শ্রমিক-সাধারণ মানুষ? আন্দোলন, সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান ও বর্ষাবিপ্লবকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে, নিজেদের সবচেয়ে বিপদে ফেলে সফল করেছে তো সাধারণ অগণিত মানুষ।
আইভরি টাওয়ারের রাজনীতিবিদরা তো নয়। তারা তো আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সর্ম্পৃক্ততাই অস্বীকার করেছিলেন। আর এখন বলছেন, আমরা গণভোট বুঝি না, জনগণ গণভোট বুঝে না। গণভোট কী জিনিস, তা তারা জানেন না। ভালো কথা। তাহলে তারা জনরায়ের জন্য অপেক্ষা করুন অতি অর্বাচীন থেকেই। জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার দিন শেষ।
কেননা যে গণভোটকে তারা জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই অনুষ্ঠিত হতে দিতে চাচ্ছেন না, সেটাই যে আমাদের জনগণের অভিপ্রায়, কথা, উচ্চারণ, সিদ্ধান্ত, সম্মতি, অনুমোদন ও রায় জানার একমাত্র বৈধ ও সর্বোচ্চ ন্যায়ানুগ, নৈতিক এবং রাজনৈতিক উপায়। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া ১৯৭২-এর সংবিধানে না থাকা সত্ত্বেও গণভোটকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৭৭ সালে বাহাত্তরের সংবিধানকে প্রকৃতপক্ষে সে পর্যায়ে যতদূর সম্ভব ন্যায্যতা দিতে চেয়েছিলেন। জিয়া ১৯৭৭ সালে সংবিধান মৌলিকভাবে বদল করে প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সংশোধন করে ১৯৭৯ সালে ২ বছর পর তা র্যাটিফাই করিয়েছিলেন।
জনগণকে পুনঃস্বক্রিয় হয়ে উচ্চারণ করতে হবেÑআমরা ঊনজন রাজনীতিবিদ চক্রের কাছ থেকে নিজেদের স্বাধীনতা, অধিকার, মর্যাদা ও কার্যকর নাগরিকসত্তাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাই। ‘আমরা জনগণ’ নিজেদের হাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সর্বোচ্চ স্বীকৃত একক শর্তভিত্তিক সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সমষ্টি ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণে প্রকৃত স্বার্থে ঐকমত্য ও জুলাই সনদের বিষয়ে গণভোট স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের পূর্বে আলাদা দিবসে চাই।
জিয়ার আদর্শ ও কাজ, ২০২৪-এর ব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা এবং ত্রয়োদশ নির্বাচনের পূর্বেই জনইচ্ছা জানা এবং জনসম্মতি লাভের জন্য দেশব্যাপী গণভোট হতে হবে। এটাই জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি। এটাই জুলাই সনদের ব্যাপারে জনইচ্ছা যাচাইয়ের প্রকৃষ্ট সুযোগ। এটাই জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া, আদালতে বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিত করা, সংবিধান-সংযুক্ত করা, সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের যথার্থ পন্থা। জনগণের গণভোট কারো দয়া নয়, এটা মৌলিক সমাজচুক্তির কেন্দ্রীয় স্মারক। তা কোন দলের পক্ষে বা বিপক্ষে গেল তাতে কিছু যায় আসে না।
গণভোট এখনকার পর্যায়ে জনঐক্যের, সমষ্টি ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত জানার, আধিপত্যবাদ রুখে দেওয়ার, দেশ বাঁচানোর, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার, জনমালিকানা ফিরে পাওয়ার এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও নবনির্মাণের একমাত্র উপায়। রাষ্ট্র, রাজনীতি, ক্ষমতাসম্পর্ক, সরকার, বরাদ্দ ব্যবস্থাপনা এবং ইনপুট ও আউটপুটের মধ্যে দ্বৈত এবং পারস্পরিক সংযোগ, সংহতি, সাড়াদান এবং নিরত বোঝাবুঝির আদান-প্রদান নিশ্চিত করে উচ্চ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর উন্নয়ন সমতা ও সচলতাকে কাম্যমানে রাখতে হলে জনক্ষমতায়নের নিত্যদিন সীমাবর্ধন অনস্বীকার্য। ওখানেই সর্বপ্রাধান্য গণভোটের ও গণমতের।
অধ্যাপক (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়