Image description
চট্টগ্রামে আত্মরক্ষায় অস্ত্রধারীদের গুলি করার নির্দেশের পর ট্রাফিক পুলিশকেও দেয়া হলো অস্ত্র, টহল-তল্লাশি অভিযান জোরদার

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে টার্গেট কিলিংসহ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী। সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী এবং নাশকতাকারীদের মোকাবেলায় রীতিমত রণসাজে সজ্জিত হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার ইতোমধ্য অস্ত্রধারীকে ‘দেখামাত্র গুলি করে হত্যার’ নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে এতদিন খালি হাতে রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) এবং সার্জেন্টদের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হয়েছে। এখন ট্রাফিক পুলিশ রিভলবার হাতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন।

আবার টহল পুলিশ সদস্যদের হাতে হাতে অস্ত্র দেয়া হচ্ছে। যাতে যেকোন পরিস্থিতিতে অস্ত্রধারীদের কুপোকাত করা যায়। অস্ত্র হাতে দিয়ে আত্মরক্ষায় গুলির নির্দেশের ফলে পুলিশের মনোবল ও সাহস বাড়ছে। অন্যদিকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তারা এখন প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠছে। জেলা পুলিশও অস্ত্র উদ্ধারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে। সন্ত্রাস কবলিত রাউজানসহ বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার হচ্ছে। এরফলে সন্ত্রাসী অন্ত্রধারীরা এখন দৌঁড়ের ওপর রয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী তথা নাশকতাকারীরও চাপে পড়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামে কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে জামিনে বের হয়ে আসে। আবার আওয়ামী লীগের দোসর হিসাবে পরিচিত অস্ত্রধারীরাও রঙ বদল করে মাঠে নামে। পাতাল জগতে নতুন মেরুকরণ হয়। এই নিয়ে সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি আর অস্ত্রবাজিতে লিপ্ত হয়। ইতোমধ্যে মহানগরী ও জেলায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে অর্ধশতাধিক খুনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে নগরীর পাঁচলাইশ, বাকলিয়া এবং রাউজান, মীরসরাই ও সীতাকু-ে একের পর লাশ পড়তে থাকে। সর্বশেষ নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার চালিতাতলীতে নগর বিএনপির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম-৮(বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে সরাসরি গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাতে এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান যুবদল নেতা ও পুলিশের খাতায় তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন সশস্ত্র সন্ত্রাসী অংশ নেয়। যদিও পুলিশ বলছে এরশাদ উল্লাহ ওই দিনের গুলির ঘটনার মূল টার্গেট ছিলেন না।

মূলত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কারাবন্দি ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা সরোয়ার হোসেন বাবলাকে হত্যা করতেই ওই গণসংযোগ কর্মসূচিতে গুলিবর্ষণ করে। তার আগে নগরীর বাকলিয়ায় বাবলাকে হত্যা করতে চলন্ত প্রাইভেটকারের পেছনে ধাওয়া করে গুলিবর্ষণ করে মোটরসাইকেল আরোহী একদল সন্ত্রাসী। ওই ঘটনায় প্রাভেটকারে থাকা দুইজনের প্রাণ গেলেও ভাগ্যক্রমে সে বার প্রাণে বাঁচেন বাবলা। সম্প্রতি নগরীর বাকলিয়ায় ছাত্রদলের দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে এক ছাত্রদল নেতা মারা যান।

তার আগে নগরীর অদূরে হাটহাজারীর মদুনাঘাটে প্রকাশ্যে চলন্ত প্রাইভেটকারে থাকা বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ১৫ মাসে শুধুমাত্র রাউজানেই বন্দুকধারীদের গুলিতে ১৭ জন খুন হন। মহানগরী ও জেলায় একের পর টার্গেট কিলিংয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্যে দিনদুপুরে হত্যাকান্ডের ঘটনায় খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া তা-বে নতুন মাত্রা যোগ করে অবৈধ অস্ত্র। সীমান্ত পথে আসছে ভারী অস্ত্র। আবার গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের দিন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে লুট করে নেয়া অস্ত্রও অপরাধীদের হাতে রয়েছে। থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের একটি অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে এসব অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এই অবস্থায় অস্ত্রধারীদের বাইরে রেখে আগামী জাতীয় নির্বাচন কিভাবে শান্তিপূর্ণ হবে তা নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশ ও এলিট বাহিনী র‌্যাব চট্টগ্রামে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান জোরদার করে। এরমধে রাউজানে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। নগরীতে বাবলা হত্যাসহ বিভিন্ন হত্যাকান্ডে জড়িত অনেকে ধরা পড়ে।

এদিকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের মধ্যেই সিএমপি কমশিনার হাসিব আজিজ অস্ত্রধারীদের দেখামাত্র গুলি (ব্রাশফায়ার) করে হত্যার নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার সিএমপির সব থানা-ফাঁড়িতে দায়িত্বরতসহ সকল পুলিশ সদস্যদের বেতার (অয়্যারলেস) বার্তায় কমিশনার মৌখিকভাবে এ নির্দেশনা দিয়েছেন। সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, অস্ত্রধারী গুলিবর্ষণের আগেই নাগরিকের এবং পুলিশের আত্মরক্ষায় গুলি ছুঁড়তে হবে। দন্ডবিধি অনুযায়ী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দন্ডবিধিতে আমাকে আত্মরক্ষার অধিকার দেয়া হয়েছে। সুতরাং যে গুলি করবে, তাকে পাল্টা গুলি করে হত্যার অধিকার আমার আছে। একজন আইন মান্যকারী সুনাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে এ পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার আছে।

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৬, ৭ ও ৮ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশের অস্ত্র লুট হয়েছে। ফলে অনেক অস্ত্র বাইরে চলে গেছে। এসব অস্ত্র যে সন্ত্রাসীদের কাছে যায়নি, কিংবা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। কিছুদিন আগে নির্বাচনি গণসংযোগে যে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে যে অটোমেটিক পিস্তল ব্যবহার হয়েছে, সেটাও পুলিশের অস্ত্র হতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে আমি নির্দেশনা দিয়েছি, যে বা যারা অস্ত্র নিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হবে তাকে যেন গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এটা দন্ডবিধির ৭৫, ৭৬, ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় উল্লেখ আছে।

সিএমপি কমিশনার আরো বলেন, আগেও এটা (নির্দেশনা) ছিল, এখন আবারও দেয়া হয়েছে। পার্থক্যটা হচ্ছে, আগে ছিল সিঙ্গেল রাউন্ড ফায়ার, এবার হবে ব্রাস্টফায়ার। অনেকে ভাববেন ব্রাশফায়ার, আসলে এটা হবে ব্রাস্টফায়ার। একসঙ্গে একাধিক গুলি বের হবে। আমি দূঢ়ভাবে বলতে চাই, এই নির্দেশনা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ে শহরে পুলিশের টহল, চেকপোস্ট অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, সিএমপির সকল সদস্য এই নির্দেশনা সুন্দরভাবে প্রতিপালন করবে। এর আগে গত আগস্টে সিএমপি কমিশনার একইভাবে বেতার বার্তায় পুলিশের কোনো টহল দলের সামনে কিংবা অভিযানের সময় কেউ অস্ত্র বের করলে আত্মরক্ষায় দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অপরদিকে নগরীর আইন-শৃঙ্খলার বিরাজমান পরিস্থিতিতে ট্রাফিক পুলিশের প্রায় তিনশ’ কর্মকর্তাকে রিভলবার সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক সাথে রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের নগরীতে যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা এবং নগরবাসীর জীবন রক্ষায় এসব অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র পুলিশের ইউনিফর্মের অংশ। তাই এসব অস্ত্র বহন ও ব্যবহারের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
মহানগরীতে ট্রাফিক বিভাগের চারটি জোন রয়েছে। এই চারটি জোনে সর্বমোট ২৯ জন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) এবং ২২৭ জন সার্জেন্ট রয়েছেন। টিআই এবং সার্জেন্টদের কখনো রিভলবার ব্যবহার করতে দেখা যেতো না। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সবার কোমরেই রিভলবার শোভা পাচ্ছে।

সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মোড় ও সংবেদনশীল এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক কর্মকর্তারা যাতে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন এবং তাদের চোখের সামনে সংঘটিত যে সন্ত্রাসী ঘটনা প্রতিরোধ এবং নগরবাসীর জীবন রক্ষা করতে পারেন সেজন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
টিআই ও সার্জেন্টরা দায়িত্ব পালনকালে নিয়ম অনুযায়ী রিভলভার বহন করবেন এবং শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে নিজের বা অন্যের প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে এসব অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি থাকবে। যেকোনো পরিস্থিতি এবং নাশকতা এড়াতে টহল টিমগুলোকে এসএমজি ছাড়াও, শিশা শটগান, দুটি গ্যাস গান এবং টিম ইনচার্জকে নাইন এমএম পিস্তল বহন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া স্থায়ী চেকপোস্ট সাতটি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করতে আদেশ দিয়েছেন কমিশনার। পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেছেন, চট্টগ্রামে হয় সন্ত্রাসী থাকবে, নয়তো পুলিশ থাকবে। পুলিশ সন্ত্রাসী একসাথে থাকতে পারবে না। সন্ত্রাসীদের কোন ছাড় নয়। নির্বাচনের আগেই সব অস্ত্রধারীকে জেলে ঢুকতে হবে।