Image description
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি

বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ আহূত ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এরই মধ্যে জানিয়েছেন, গত ১১ দিনে ১৫টি জায়গায় ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, আর গত দুই দিনে ৯টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় জনমনে ভয়ের সঙ্গে দেখা দিয়েছে কৌতূহল। তাদের প্রশ্ন, দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আবার কী ঘটতে যাচ্ছে?

অবশ্য ‘লকডাউন’ কর্মসূচির নামে যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ টহল জোরদার করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনারও বলেছেন, লকডাউন নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। ঢাকার মানুষ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আমরা সবাই মিলে এটি রুখে দেব। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের লকডাউন ঠেকাতে রাজপথে থাকার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণা করার কথা রয়েছে। এ মামলার সহ-অভিযুক্ত হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আরও কয়েকজন পলাতক রয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। ফলে দলটির নেতারা বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের লকডাউন ঘিরে ঢাকায় বড় ধরনের গোলযোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

লকডাউন প্রতিরোধের ঘোষণা বিরোধীদের: গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে ঝটিকা মিছিল আর সামাজিক মাধ্যমে (ফেসবুক) সরব থেকে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। বিশেষ করে চলতি বছরের মে মাসে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির পর মূলত দলটির সভানেত্রীর ভার্চুয়াল বক্তৃতা আর বাংলাদেশে ঝটিকা মিছিলই মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছিল। গত বছরের নভেম্বরে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের কথা জানানোর পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচিও ঘোষণা করল আওয়ামী লীগ। মূলত, এ কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্ব রাজপথে নিজেদের অবস্থান প্রদর্শন, কর্মীদের সক্রিয় রাখা এবং জনমনে নিজেদের প্রভাব পুনর্গঠনের একটি কৌশলগত প্রয়াস চালাচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এক ধরনের ‘প্রতিরোধের টেস্ট কেস’ হিসেবে দেখছেন—যা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, তারা ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। এরই মধ্যে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে থাকে। সর্বশেষ গত দুদিনে বেশকিছু বাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য সম্প্রতি এক ভিডিওবার্তায় ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ এবং ১৩ নভেম্বর ঢাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করলে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরাসরি মাঠে না থাকলেও বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা এ লকডাউন বা কোনোরকমের নাশকতা হলে তা ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিরোধের কথা জানিয়েছে।

জনমনে কৌতূহল, আতঙ্ক: লকডাউনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এমন নাশকতার ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন হওয়ার পর জনগণ একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ আশা করেছিল। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে এমন সহিংসতা ও রাজনৈতিক সংঘাত প্রমাণ করে, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এখনো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জনজীবনের স্বাভাবিকতা বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে।

সাধারণ মানুষ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। সেই অভ্যুত্থান ছিল মূলত সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সংস্কার, বিচারিক স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেও বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো সেই পুরোনো বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। অভ্যুত্থানের আগেও বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি মানেই ছিল সংঘাত, জ্বালাও-পোড়াও এবং আতঙ্ক। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের লকডাউনের ডাক এবং এর আগে-পরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে ‘মাঠ দখলের’ পুরোনো সহিংস কৌশলকেই আঁকড়ে ধরে আছে।

নাশকতা রোধে কঠোর সরকার: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে কয়েকদিন ধরেই ঝটিকা মিছিল, হাতবোমা বা ককটেলের বিস্ফোরণ এবং যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এসবের জন্য আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগকে দায়ী করছে পুলিশ। তবে আজ লকডাউন ঘিরে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হলে ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ার মনোভাব নিয়ে সাজানো হয়েছে নিরাপত্তা বলয়। যার অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার ভেতর ও প্রবেশপথগুলোয় গতকাল বুধবার থেকে কড়া নজরদারি শুরু হয়। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোশাকধারী পুলিশের মোটরসাইকেলে করে টহল চোখে পড়েছে। আজ ঢাকার প্রবেশপথগুলোয় যে কোনো ধরনের জমায়েত ঠেকাতে কাউকে দাঁড়াতেই দেওয়া হবে না। যে কোনো ধরনের অরাজকতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। এ কর্মসূচি ঘিরে অরাজকতা ঠেকাতে সন্দেহভাজন ব্যক্তি দেখলেই আইনের আওতায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরও সহায়তা চেয়েছে সরকার।

চ্যালেঞ্জের মুখে স্থিতিশীলতা: আওয়ামী লীগের ‘লকডাউন’ এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, নভেম্বর মাসে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামী এবং সমমনা সাতটি দলের কর্মসূচি ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার পরীক্ষা নয়, বরং জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখেছিল জনগণ, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। যতদিন না রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাত ও সহিংসতার পথ পরিহার করে, গণতান্ত্রিক রীতি ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত হচ্ছে, ততদিন এই দেশ পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছায়া থেকে মুক্ত হতে পারবে না। গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং রাজপথ দখলের হুমকি এটাই প্রমাণ করে যে, দেশের রাজনৈতিক চরিত্র বদলাতে হলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন জরুরি।