সীমান্তে সীমাহীন তল্লাশি ও নজরদারির মাঝেও ঢুকে যাচ্ছে জাল টাকা। এত নিখুঁত নোট সাধারণ মানুষ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাকেও বিভ্রান্ত করছে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচন নিরাপত্তার জন্য এটি এখন শুধু আর্থিক নয়, রাজনৈতিক হুমকি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চক্রের মূল হোতা হাসান ও সহযোগী রাসেল ভারতের ভেতরে জাল নোট তৈরি করে বাংলাদেশে সরবরাহ করে।
এক লাখ জাল টাকার জন্য ক্রেতাকে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা দিতে হয়। প্রতিটি বান্ডেল এতটাই নিখুঁত যে বিশেষজ্ঞরা না দেখলে তা আসল টাকার সঙ্গে আলাদা করতে পারছেন না। নোটগুলোতে পরিবর্তনশীল রঙের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকলেও ইউভি ফিচার নেই, যা কেবল মেশিনেই শনাক্ত করা সম্ভব।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী এলাকার ৪৯ বছর বয়সী হতদরিদ্র নারী শাহিনা বেগম সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছেন।
তিনি শেরপুর পোস্ট অফিস থেকে পাঁচ বছর ধরে সঞ্চয় করা টাকা ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে জানতে পারেন, পুরো টাকাই জাল। একই দিন ওই পোস্ট অফিস থেকে আরেকজন ২৫ হাজার টাকার জাল নোট পান। সিসিটিভি ফুটেজ ও ব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে পোস্ট অফিসের ক্যাশিয়ার মানিক মিয়া ও ট্রেজারার হাফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে হাফিজুর বলেন, নোটগুলো পোস্ট অফিস থেকেই দেওয়া হয়েছিল।
গ্রেপ্তার কর্মচারীদের কললিস্ট ধরে বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁরা সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী এলাকার চক্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। স্থানীয়রা জানান, মাদক, প্রসাধনী ও অন্যান্য চোরাচালানের সঙ্গে জাল টাকার চালানও সীমান্ত পেরিয়ে আসছে।
বিজিবি জানায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৫ জন আসামিসহ ২৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্য, গবাদি পশু, মাদক ও জাল টাকা উদ্ধার করেছে।
সাম্প্রতিক অভিযানে গোপালগঞ্জ সদর থানার পুলিশ দুই জাল টাকা ব্যবসায়ী হাবিবুর ও রিপন শেখকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের কাছ থেকে দুই লাখ ৪৩ হাজার জাল টাকা, নগদ তিন লাখ ৮৩ হাজার আসল টাকা এবং একটি প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়।
তাঁদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে এবং আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। হাবিবুরের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতিসহ দুটি মামলা এবং রিপনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাল টাকা অনুপ্রবেশের বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। কারণ টাকার সঠিক প্রচলন ব্যাহত হলে অর্থনীতিতে ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। আমাদের অর্থনীতিতে এক টাকার প্রভাব পাঁচ গুণ পর্যন্ত।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি ব্যাংকের কাছে জাল নোট পাওয়া যায়, আইন অনুযায়ী ব্যাংকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যার কাছেই নোট পাওয়া যাবে, সে-ই অপরাধী। তাই নোট গ্রহণের সময় ব্যাংকগুলোকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।’
বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে জাল টাকা পাচারের যেকোনো চেষ্টা প্রতিরোধে আমরা নিয়োজিত আছি। বিশেষ করে শেরপুরের পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যেন কোনোভাবে জাল টাকা দেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য টহল, অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।’
জয়পুরহাট ২০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল লতিফুল বারী জানান, ‘জাল টাকার তথ্য পাওয়ার পর থেকেই অতিরিক্ত টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি চালু হয়েছে এবং পোস্টগুলোকে কড়া সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, কিছু মহল ভোটার বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য নতুন করে জাল নোট বাজারে ছড়াতে পারে। ফলে জাল টাকা এখন শুধু আর্থিক নয়, রাজনৈতিক নিরাপত্তার হুমকিতেও পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সুপারনিউমারি অধ্যাপক ও বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হেলাল আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে জাল টাকা প্রবেশ করলে অবশ্যই দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সরকার যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছে। ব্যাংকগুলোও সতর্ক। ডিজিটাল লেনদেন ও জনসচেতনতার ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে। তাই নেতিবাচক প্রভাব কম হবে।’