বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ তরুণ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবেন। তবে ৯৭.২ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে চান। আর ১৭.৭ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের পছন্দের দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) পরিচালিত ‘ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে ২০২৫’-এ এই তথ্য উঠে এসেছে।
সার্ভের ফলাফল প্রকাশ করা হয় গতকাল বুধবার ঢাকার বিওয়াইএলসি সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে।
সংগঠনটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আকাঙ্ক্ষা বোঝার লক্ষ্যে এই জরিপটি পরিচালিত হয়, যা সম্পূর্ণ সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
জানা যায়, জরিপটি ২০২৫ সালের ১০ থেকে ২১ অক্টোবরের মধ্যে দেশের আটটি বিভাগ, ২৭টি জেলা ও ১৭৫টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটে পরিচালিত হয়। এতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মোট দুই হাজার ৫৪৫ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেন।
এর মধ্যে গ্রামাঞ্চল থেকে ৫৬.৭%, শহরাঞ্চল থেকে ২৬.১% এবং উপশহর থেকে ১৭.২% অংশ নেন। লিঙ্গভিত্তিক হিসাবে পুরুষ ৫০.৪% এবং নারী ৪৯.৬%।
ভোটের আগ্রহ ও রাজনৈতিক পছন্দ
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮৯% নিবন্ধিত ভোটার এবং ৯৭.২% আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে ইচ্ছুক। যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক পছন্দের দিক থেকে এগিয়ে বিএনপি।
দলটিকে ভোট দিতে চান ১৯.৬% তরুণ। এর পরই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটিকে ১৬.৯% তরুণ ভোট দিতে চান। এ ছাড়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ৯.৫%, জাতীয় নাগরেক পার্টিকে (এনসিপি) ৩.৬%, জাতীয় পার্টিকে (জাপা) ০.৪%, অন্যান্য ইসলামী দলকে ১.৫%, অন্যান্য দলকে ০.৭%, বাম দলকে ০%, সিদ্ধান্তহীন ৩০%, দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৭.৭%। জরিপে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলে ৪৩.১% তরুণ জানিয়েছেন তাঁরা ভোট দেবেন। আর ৫৬.৯% জানিয়েছেন তাঁরা ভোট দেবেন না।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আস্থা
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে ৪৯.৮% তরুণ আস্থাশীল, ১৮.৫% আস্থাশীল নন এবং ৩১.৬% নিশ্চিত নন। এ ছাড়া পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় বর্তমান সময়ে ৬৩.১% তরুণ মনে করেন, তাঁরা জনসমক্ষে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশে বেশি নিরাপদ, যেখানে ৩৬. ৯% তা মনে করেন না।
ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষার পরিবেশ
ন্যায্যতাভিত্তিক ও বাধাহীন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় ছাত্ররাজনীতির প্রভাব সম্পর্কে তরুণদের মধ্যে ইতিবাচকভাবে দেখেন ৩৮.৯%, নেতিবাচকভাবে দেখেন ৫২.৬%, নিশ্চিত নন ৮.৫%। বেশির ভাগ তরুণ (৫২.৬%) মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে ৪৮% রাজনৈতিক প্রভাবকে, ২৩.৮% সহিংসতা ও সংঘর্ষকে এবং ১১.১% ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহারকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অগ্রাধিকারে দুর্নীতি দমন ও সামাজিক সম্প্রীতি
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা আগামী পাঁচ বছরে দেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বিষয়ে ৬৭.১% উত্তরদাতা দুর্নীতি নির্মূলকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দেখেছেন। ধর্ম ও জাতিগত উভয় দিক বিবেচনায় ৬৫.৩% তরুণ মনে করেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আছে, ২৩.৫% অভাব দেখেন এবং ১১.২% নিশ্চিত নন।
নারী নিরাপত্তা ও সামাজিক চিত্র
বর্তমান বাংলাদেশে নারীরা নিরাপদ কি না জানতে চাইলে ৭৬% তরুণ মনে করেন, নারীরা নিরাপদ নন। আর ২৪% মনে করেন, নিরাপদ আছেন। এই তথ্য লিঙ্গভিত্তিক অনিরাপত্তার উদ্বেগজনক বাস্তবতা তুলে ধরে, যা তাৎক্ষণিক নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দাবি করে।
তরুণদের কর্মজীবনের আকাঙ্ক্ষা
জীবিকা হিসেবে ৪১.৯% তরুণ বেতনভুক চাকরি করতে চান, ৩৯.১% উদ্যোক্তা হতে চান, আর ১৮.৯% এখনো নিশ্চিত নন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৫.৯% দেশে চাকরি করতে চান, আর ২৪.১% বিদেশে কর্মসংস্থান খুঁজতে আগ্রহী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বাস্তবতা
৫৯.৬% তরুণ মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে না। দেখা গেছে, জরিপে চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ৬১.৭% উত্তরদাতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী, যাকে তরুণসমাজের দৃঢ়তা ও দেশের অগ্রগতির প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ভয়েস ফর রিফর্মের সহসমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হতে চান। এর পেছনে বড় কারণ চাকরির বাজারে সুযোগের ঘাটতি। তবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো দিতে ব্যর্থ।’
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, ‘তরুণরা শিক্ষা, জীবিকা ও রাজনীতি নিয়ে ভাবে, হতাশাও ভোগ করে। তবু দেশের ৬১.৭% তরুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ও ইতিবাচক, বিওয়াইএলসির জরিপে সেটাই উঠে এসেছে।’
বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনাহ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সামাজিকভাবে জাগ্রত এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। তাদের কথা শোনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা এবং তাদের মত অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করা এখন অত্যন্ত জরুরি।’
বিওয়াইএলসির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‘যাঁরা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় বা নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে যাবেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা ফেরাতে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।’
বিওয়াইএলসির লিড ফ্যাকাল্টি মুনিরা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের দেশের তরুণদের আছে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতা। তাদের শুধু সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং উন্নতির সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’