প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেলের বিশেষ দুই প্রকল্প ‘ঢাকা-যশোর’ ও ‘দোহাজারী-কক্সবাজার’ রেলপথে দিনে সাতটি ট্রেন চলছে। এ দুটি রুটে বছরে আয় ১১৪ কোটি টাকা। আর ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৬৫০ কোটি টাকা। ব্যয়ের তুলনায় আয় একেবারেই তলানিতে।
রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে বাস্তবায়িত প্রকল্প দুটি ছিল হরিলুটের। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যথাযথ সমীক্ষাও করা হয়নি। প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ব্যয় ১৭৮ কোটি থেকে ২৩৩ কোটি টাকা ধরা হয়। বিশ্বের কোথাও প্রতি কিলোমিটার রেলপথ তৈরিতে এত বেশি টাকা ব্যয়ের নজির নেই। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ এলাকায় প্রতি কিলোমিটার রেলপথ তৈরিতে ২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রস্তাব অনুযায়ী-১০১ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রুট এবং ১৭২ কিলোমিটারের ঢাকা-যশোর রুটে দিনে ২০০টি ট্রেন চলাচল করার কথা। কিন্তু প্রকল্প উদ্বোধনের পর থেকে তিন বছর ধরে দিনে মাত্র সাতটি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী কোনো ট্রেন চলছে না। কক্সবাজার রুটে ১০ মাসে ট্রেন পরিচালনা করে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। আর এ প্রকল্পে ২০২৪ সালে ৪২০ কোটি টাকা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছে। কিস্তির পরিমাণ প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা বাড়বে।
যদিও সমীক্ষায় বলা হয়েছিল-ট্রেন যাত্রার প্রথম বছর যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করে কক্সবাজার রুটে পৌনে ৮০০ কোটি টাকা আয় হবে। আর যশোর রুটে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা আয় হবে। এছাড়া প্রতিবছর আয় বাড়বে।
সূত্র জানায়, একটি প্রকল্প ১৮শ কোটি টাকার বদলে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যটি ২২ হাজার কোটি টাকার বদলে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্প দুটি গ্রহণ ও বাস্তবায়নকালে-রোলিংস্টক (ইঞ্জিন-কোচসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম) সংগ্রহ করা হলে দুই শতাধিক ট্রেন পরিচালনা সম্ভব হতো। রোলিংস্টক ক্রয় ও রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণে নজর না দিয়ে তৎকালীন সরকার একের পর এক রেলপথ নির্মাণ করেছে।
রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় ধরে লুটপাট করা হয়েছে। শুধু লুটপাটের আশায় কক্সবাজার আইকন ও ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ দুটি স্টেশন নির্মাণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
কক্সবাজারে আইকন রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণের প্রায় তিন বছর পরও পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহার করা যায় না। ২৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাঁচতলা বিশিষ্ট স্টেশনটিতে আধুনিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিটেইল শপ, মালটি পারপাস হল, ব্যাংকসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ৪০টি কক্ষবিশিষ্ট হোটেল ফাঁকা পড়ে আছে। সব অবকাঠামো অলস পড়ে আছে। অযত্নে-অবহেলায় সব নষ্ট হচ্ছে। স্টেশনটি বেসরকারি খাতে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অর্থনৈতিক রিটার্ন ঢাকা-যশোর রুটে ৩০ বছর এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে ১৭ বছর ধরা হয়েছে।
লুটপাটের নেশায় ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনতলা ‘ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশন’ স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানান, ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশনের আগে (৫ কিলোমিটার) একটি এবং পরে (১১ কিলোমিটার) আরেকটি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। মাঝখানে এ স্টেশনের প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া স্টেশনটি লোকালয় থেকে অনেকটাই দূরে। শেখ হাসিনা, তার ফুপাতো ভাই সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন ও সংসদ-সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের রাজনীতিক চাপে পরিকল্পনাহীনভাবে স্টেশনটি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। স্টেশনটি নির্মাণের প্রায় শেষ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকার সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর প্রাক্কলন করে।
সূত্র জানায়, দুই প্রকল্পে বছরে সুদসহ প্রায় ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অথচ এ দুই রুটে বছরে আয় হচ্ছে মাত্র ১৪৪ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেললিংক হয়ে যে পাঁচটি ট্রেন চলাচল করে, সেগুলো এক সময় যমুনা সেতু হয়ে চলাচল করত। এ রুট উদ্বোধনের পর কৌশলে ট্রেনগুলোর রুট (যমুনা রেলসেতু) পরিবর্তন করা হয়। পুরাতন ট্রেন নতুন রুটে চলছে। প্রকল্প দুটির নথিপত্র অনুযায়ী-এ দুই রুটে ন্যূনতম ১২০টি ইঞ্জিনসহ ২ হাজার ২০০ কোচ এবং ৫০টি মালবাহী ট্রেন চালানো হলে যথাযথ আয় উঠে আসবে।
প্রকল্প দুটি ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে রেলের তিন সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে। প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। ১৫ বছরে রেলে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ও সময় কয়েক দফা করে বাড়ানো হয়েছে। লুটপাট আর বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে রেলের পরিচালন ব্যয় ঠিকমতো উঠে আসছে না। ফলে প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নতুন দুটি বিশেষ রেলপথে প্রচুর যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব। কিন্তু ইঞ্জিন-কোচ রোলিংস্টক সামগ্রী না থাকায় নামে মাত্রই ট্রেন চালাতে হচ্ছে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটে মাত্র দুটি ট্রেন চলছে। ১০ দিন আগে ট্রেনগুলোর টিকিট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এ রুটে প্রায় অর্ধশত ট্রেন চালালেও যাত্রীদের চাহিদা থাকবে। অনুরূপভাবে ঢাকা-যশোর রুটেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ট্রেন না চালাতে পারায় আয় হচ্ছে না। আয় বাড়লে রেল থেকেই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব। বর্তমানে রেলে ইঞ্জিন-কোচসহ রোলিংস্টক সামগ্রীর ভয়াবহ স্বল্পতা রয়েছে। চলমান ট্রেন চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, রেলে উল্লেখিত দুটি বিশেষ প্রকল্পে যে ব্যয় করা হয়েছে-তা খুবই অস্বাভাবিক। এসব উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতরা লাভবান হয়েছে। কোনোটাতেই সমন্বিত পরিকল্পনা ছিল না। বড় প্রকল্পে ঋণের বোঝাও বড়। প্রকল্পগুলো আয় বাড়ানোর বদলে উলটো লোকসানের পাল্লা ভারী করছে। তিনি বলেন, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নকালে এর রিটার্ন পেতে সুপরিকল্পনা অনুযায়ী রোলিংস্টক সামগ্রী সংগ্রহ করতে হয়। সমাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুতে যেন প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী ট্রেন পরিচালনা করা যায়। রেলে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ শুধু নয়, প্রমাণও মিলছে। প্রকল্প হরিলুটের হলে-কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না-এটাই স্বাভাবিক।
রেলপথ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, বিগত সরকার যে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে-এর অধিকাংশই সূদুরপ্রসারী নয়। আর অনিয়ম-দুর্নীতি তো আছেই। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দোহাজারী-কক্সবাজার ও পদ্মা সেতু রেললিংক প্রকল্পে ব্যয় কমিয়েছে। অর্থাৎ এসব প্রকল্পে ব্যয় বাড়িয়ে লুটপাটও হয়েছে। ইঞ্জিন-কোচসহ রোলিংস্টক স্বল্পতা চরম আকার ধারণ করছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা কিছু ইঞ্জিন-কোচ যুক্ত করতে পারব। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে রোলিংস্টক সামগ্রী রেলে যুক্ত না হলে ট্রেন পরিচালনায় ভয়াবহ বিঘ্ন ঘটতে পারে।