বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধকে পাশ কাটিয়েই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে আদেশ চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আদেশে স্বাক্ষর করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা সমঝোতায় আসতে না পারায় সরকারকেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হলো। প্রধান উপদেষ্টা আজ দুপুরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ঘোষণা করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১০ নভেম্বর সে সময় শেষ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসেনি; এমনকি কোনো আলোচনায়ও বসেনি। এ অবস্থায় সরকার এখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর দুটো সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপরই গণভোট, নোট অব ডিসেন্ট, পিআর পদ্ধতিসহ কয়েকটি বিষয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যায় বড় দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে সমঝোতায় পৌঁছাতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়, কিন্তু দলগুলো সমঝোতায় আসেনি। জামায়াতে ইসলামী আলোচনার ডাক দিলেও বিএনপি তাতে সাড়া দেয়নি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কোনো দল নয়, সরকার ডাকলে আলোচনায় অংশ নেবে তারা। দুটি রাজনৈতিক দলের এমন মুখোমুখি অবস্থান থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে পর্দার আড়ালে চলে সমঝোতার আলোচনা।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ১১ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দুই তিন দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে সরকার। তিনি বলেন, সব দলের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছি। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ভালো কিছু হবে। আশা করি, সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত সব দল মেনে নেবে।
আইন উপদেষ্টা এমন সময় এ তথ্য প্রকাশ করলেন যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষের নজর উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের দিকে। সরকারের সিদ্ধান্তের পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ওপরই দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্ভর করছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে ১১ নভেম্বরও বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতারা পরস্পরকে হুমকি ও পালটা হুমকির সুরে কথা বলেছেন। তবে দল দুটির দাবি মানার ক্ষেত্রে সরকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। এ জন্য কয়েকটি প্রস্তাব সরকার বিবেচনায় নিয়েছে।
প্রথমত, সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একই দিনে হবে। এছাড়া পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে গঠিত হবে সংসদের উচ্চকক্ষ। গণভোটে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোর ওপর বিভিন্ন দলের দেয়া নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সনদ বাস্তবায়নে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটিও তুলে দেয়া হবে। কিন্তু আগামী সংসদের জন্য সরকার একটি বিল তৈরি করে দেবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে কঠোর অবস্থান দেখালেও পর্দার আড়ালে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত তারা মেনে নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এর বাইরে তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। তবে প্রকাশ্যে বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি অবস্থানে। ১১ নভেম্বর রাজধানীর পল্টনে সমাবেশ করে জামায়াতসহ ৮টি ইসলামি দল। সেখানে ঘোষণা দেয়া জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া ২০২৬ সালে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, জুলাই বাস্তবায়নে ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে বলা হয়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। কিন্তু আদেশ জারির আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গত ৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর আহ্বান করা হয়। কিন্তু দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। প্রকাশ্যে তারা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি বলছে, সংস্কার ও গণভোট চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্যে অবস্থান এবং পর্দার আড়ালে কথাবার্তা এক নয়। সামনে ভোট। তাই মাঠ চাঙা রাখতে প্রকাশ্যে এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু কখনোই এটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে যাবে না। কারণ সংকট বাড়লে, এর সম্ভাব্য ঝুঁকি ও পরিণতি কী হতে পারে সেটি অবশ্যই তাদের বিবেচনায় রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, এই সনদ নিয়ে শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার প্রধান উপদেষ্টার কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, আজ উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের জন্য কয়েকজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান অন্যতম।
সূত্র জানায়, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনে এখন আর বিএনপির আপত্তি নেই। কিন্তু এখন দলটির বড় ইস্যু নোট অব ডিসেন্ট। কারণ মৌলিক ২০টি সংস্কারের ১১টিতে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন অন্যতম। এছাড়া সনদে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে। সেখানে কমিশনের সিদ্ধান্ত-বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, আইন কমিশন ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নিয়োগ সরকারের হাতে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই বিশেষ সার্চ কমিটির মাধ্যমে এগুলো প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেবেন। একই ব্যক্তি সরকার প্রধান, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা থাকতে পারবেন না। এসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে নির্বাহী একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া জুলাই সনদে উল্লেখ ছিল, নোট অব ডিসেন্টসহ দলগুলো এই সনদ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। এরপরও জনগণ তাদের ভোট দিলে প্রতিশ্রুতি অনুসারে সনদ বাস্তবায়ন করবে। অপরদিকে ঐকমত্য কমিশন, জামায়াত ও এনসিপির বক্তব্য হলো ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬১টি প্রস্তাবের কোনোটিতে পূর্ণাঙ্গ এবং কোনোটিতে আংশিক নোট অব ডিসেন্ট আছে। ফলে এগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া সনদের কোনো গুরুত্ব থাকে না।
জানা গেছে, রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই সনদে মোট ৮৪টি প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশ অনুসারে প্রস্তাবগুলো তিন ভাগে বাস্তবায়ন করা হবে। ৯টি নির্বাহী আদেশে, ২৭টি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এবং সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। পরবর্তী সংসদ দুটি দায়িত্ব পালন করবে। প্রথমত, সংবিধান সংস্কার পরিষদ। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত আইনসভা। সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে বলা হয়, আগামী সংসদে নির্বাচিত সদস্যরা প্রথম অধিবেশন শুরুর ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই অনুসারে সংবিধান সংশোধন করবেন। এই সময়ের মধ্যে তারা সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে। সনদ বাস্তবায়নে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ভিত্তি ধরে সরকার একটি আদেশ জারি করবে। আদেশের নাম হবে : ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’। এই আদেশের ওপরই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গত ১৭ অক্টোবর সনদে ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে।