পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ওই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বঞ্চিত করার নেপথ্যে অভিযোগ উঠেছে খোদ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই। সংশ্লিষ্টদের দাবি, একটি অস্বচ্ছ ও ভুতুড়ে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানি মেডলগ এসএকে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনালের দেখভালের দায়িত্ব দিচ্ছে সরকার। এ নিয়ে দেশীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সংগঠন ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। দেশের প্রথম নদীভিত্তিক কন্টেইনার টার্মিনাল পানগাঁও বন্দর যা ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত। জানা গেছে, নির্মাণের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও শুল্ক বিভাগের অদক্ষতার কারণে টার্মিনালটি ঠিকভাবে পরিচালতি হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রহস্যের বেড়াজালে রেখে উন্মুক্ত দরপত্রের কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। বরং ভুতুড়ে দরপত্র আহ্বান করে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই উন্মুক্ত দরপত্রের তোয়াক্কা না করে কেবলমাত্র একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগও উঠেছে। তাদের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাকি দুটি কোম্পানিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র একটি বিদেশি কোম্পানিকে তাড়াহুড়ো করে কাজ দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আর এর উপহার স্বরূপ চট্টগ্রাম বন্দরের দুইজন এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনজন কর্মকর্তার জন্য সুইজারল্যান্ডে একটি আনন্দ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয় বলেও তথ্য এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানগাঁও বন্দর ২২ বছরের জন্য মেডলগ এসএ নামের যে প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে তা নিতান্তই রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি। দেশের অভ্যন্তরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা দক্ষতার সঙ্গে এই বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার কাজ করতে পারে। কিন্তু তাদের বঞ্চিত করে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দরের দায়িত্ব দিচ্ছে নৌ- পরিবহন কর্তৃপক্ষ। আর এর নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব স্বার্থও জড়িত বলে জানিয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর পানগাঁও বন্দর দিয়ে ২০২৩ সালে ২৯ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এরপর থেকে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কমতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে সরকার।
দেশীয় একাধিক সংগঠনের অভিযোগ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা থাকায় দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানই দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তারা সেটি পাননি। টেন্ডার প্রক্রিয়া চলাকালে যেখানে একটি বিদেশি কোম্পানি এবং দুটি বাংলাদেশি কোম্পানি টেন্ডার-এ অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় টেন্ডার চূড়ান্ত হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খোলাখুলি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে একটি টেন্ডার চলাকালীন সময়ে যেখানে তিনটি কোম্পানি অংশগ্রহণ করেছে সেখানে তারা জানালেন যে একটি বিদেশি কোম্পানিকে পানগাঁও টার্মিনালের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা জানান, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে টেন্ডার আহ্বানের বিষয়টি শুধুমাত্র ‘আইওয়াশ’। এখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতরা আগেই ঠিক করে রেখেছেন যে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হবে। তাছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে বিদেশি কোম্পানিটির নাম প্রচার করা হয়েছে মেডিটার্নিয়ান শিপিং কোম্পানি বাস্তবে ওই সেটি অংশগ্রহণ করেনি। ওই কোম্পানির একটি শাখা মেডলগ এসএ টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। যারা একেবারেই নতুন। তাদের কেবলমাত্র দু-একটি নদীবন্দর রয়েছে। তাদের আরও অভিযোগ, মেডলগ এসকে দায়িত্ব দেয়ার আগে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অমান্য করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, কোনো একটি কোম্পানিকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত করতে হলে পিপিআর অনুযায়ী পুনরায় অন্য কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দেয়ার বিধান রয়েছে। কিছুদিন সময় দিয়ে অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা যেতো। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টার তাড়াহুড়ার কারণে তা না করে শুধু এই বিদেশি কোম্পানিটিকেই যোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়।
জানা গেছে, গত ৬ই নভেম্বর টেন্ডারের টেকনিক্যাল ইভালুয়েশনের দিনক্ষণ নিধারিত ছিল। সেখানে তাড়াহুড়ো করে অপর কোম্পানিকে বাদ দেয়া হয়। কেবলমাত্র মেডলগ এসএকে রেসপনসিভ করে টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন প্রতিবেদন সম্পন্ন করা হয়। আবার তাড়াহুড়ো করে ৯ই নভেম্বর টেন্ডারের ফিন্যান্সিয়াল ইভালুয়েশনের দিন ধার্য করা হয়। এই দুই কার্যদিবসে দুটি ইভালুয়েশন কমিটিই খুব তাড়াহুড়ো করে বিদেশি ওই কোম্পনিকে যোগ্য বলে বিবেচিত করে। একইসঙ্গে ১৭ই নভেম্বর পানগাঁও বন্দরের দায়িত্ব মেডলগ এসএকে দিয়ে চূড়ান্ত করার জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।
সূত্রে আরও জানা যায়, পানগাঁও বন্দর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল এইচআর লাইন নামের একটি কোম্পানি। যার মালিকানা আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর। কিন্তু কোম্পাটির এই দরপত্রে অংশ নেয়া ছিল আনুষ্ঠানিকতা। কারণ পানগাঁও বন্দরের দায়িত্ব পেতে যাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠান মেডলগ এসএ’র মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান এমএসসি’র বাংলাদেশের প্রতিনিধি হচ্ছে সাবের হোসেন চৌধুরীর অন্য একটি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস এসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাদাত হোসেন সেলিম মানবজমিনকে বলেন, সরকারকে লুটেরা শ্রেণি ঘিরে রেখেছে। একটি দেশীয় মাফিয়া চক্র বিদেশিদের হাতে বন্দরগুলো তুলে দিচ্ছে। এটা দেশদ্রোহিতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্য আবদুল মাহবুব চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, এখন কেন বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দিতে হবে? এটা ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়। বন্দরে এখন পণ্য খালাস করতে ৬৬৫ টাকা লাগে। যা শতকরা হিসেবে ১২১ শতাংশ।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে গতকাল মানবজমিন-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি ।