Image description

শেখ হাসিনা সরকারের বিগত আমলে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদন ছাড়া ভারতীয় চিকিৎসকদের বাংলাদেশে এনে ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্প’ এর নামে ভারতের হাসপাতালগুলোর ব্যবসা বৃদ্ধি এবং দেশীয় চক্রের কমিশন বাণিজ্যের ব্যাপারটি ছিল ওপেন সিক্রেট। নিয়মবহির্ভূত এই অনুশীলন সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেত। লক্ষ্যণীয় ছিল, বাংলাদেশ পুলিশের সহায়তায় সারাদেশের পুলিশ হাসপাতালগুলোতে ‘হেলথ ক্যাম্প’ করে বেড়াতেন ভারতীয় চিকিৎসকরা। এসব কথিত ফ্রি হেলথ ক্যাম্পের বিজ্ঞাপন পুলিশের ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হত (আর্কাইভ লিংক এখানে)। জাতীয় সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হতো এসব খবর (দেখুন এখানে ও এখানে)।

বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ অনুযায়ী, চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার আগে বিদেশি চিকিৎসকদের সাময়িক নিবন্ধন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি অন্যান্য নিয়মকানুনও মেনে চলতে হয় বিদেশ থেকে আসার চিকিৎসকরদেরকে।

তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ভাটা পড়ে এসব ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্প’ আয়োজনে। বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভারতীয় ডাক্তারদের এনে ‘ফ্রি হেলথ ক্যাম্প’ আয়োজনের সাথে জড়িত ছিল এআইএমএস হেল্থ কেয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠান; একই নামে ভারতীয় একটি হেলথ ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের হয়ে তারা কাজ করে বলে তাদের ওয়েবসাইটের তথ্য থেকে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২০৭ নম্বর কক্ষটি এআইএমএস হেল্থ কেয়ারকে তথ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এইআইএমএস’র ওয়েবসাইটে তাদের তথ্য কেন্দ্রের ঠিকানা হিসেবে এখনও পুলিশ হাসপাতালের ২০৭ নম্বর কক্ষের কথা উল্লেখ রয়েছে।

এইআইএমএস হেল্থ কেয়ারের তথ্যকেন্দ্রের ঠিকানা পুলিশ হাসপাতাল | ওয়েবসাইট

গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল বহু হেলথ ক্যাম্প; যার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। তবে এআইএমএস’র ফেসবুক পেইজে অন্তত শতাধিক ক্যাম্প সংক্রান্ত পোস্ট পাওয়া গেছে; যা এই অনুসন্ধান চলাকালে পেইজটির কর্তৃপক্ষ ডিলিট করেছেন। এছাড়াও আরও বেশ কিছু ভারতীয় এবং বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ভারতীয় ডাক্তারদের এনে হেলথ ক্যাম্প আয়োজন করে থাকলেও এআইএমএস’র কার্যক্রম অনলাইনে বেশি দেখা যায়। ভারতীয় হাসপাতালগুলোর বাইরে চীনা, থাই কিছু হাসপাতালের চিকিৎসকদের দ্বারা এমন ক্যাম্প আয়োজনের খবর মাঝে মধ্যে সংবাদমাধ্যমে দেখা গেলেও সংখ্যার বিচারে কম।

গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ‘প্রশান্ত ফার্টিলিটি রিসার্চ সেন্টার’ নামে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি ফেসবুক পেইজ থেকে ভারতীয় একজন চিকিৎসক ঢাকায় এসে এমন হেলথ ক্যাম্প আয়োজন করবেন– এমন ক্যাম্পেইনের পর বিএমডিসি আয়োজক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিলে ক্যাম্পটি স্থগিত করা হয়।

 

কী করছে এআইএমএস হেলথ কেয়ার

এআইএমএস হেলথ কেয়ার ভারতের সবচেয়ে বড় মেডিকেল ট্যুরিজম কোম্পানিগুলোর একটি। তারা মূলত ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভারত এবং প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে রোগীদের আকৃষ্ট করতে নানান ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এর বিনিময়ে হাসপাতালগুলো থেকে তারা কমিশন পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির এজেন্ট হিসেবে যারা কাজ করেন তারা নিজেরাই বাংলাদেশি রোগীদের লক্ষ্য করে ‘AIMS Healthcare নামে একটি ফেসবুক পেইজ পরিচালনা করেন।

এই পেইজ থেকে নিয়মিত ভারতের বিভিন্ন হাসাপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশি রোগীদের উৎসাহিত করে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করা হয়। তাদের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, যেসব হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য প্রচারণা চালানো হয় তাদেরকেই বাংলাদেশে এনে ‘ফ্রি কনসালটেশন ক্যাম্প’ পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।

২০২৪ সালের ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ফেসবুক পেইজে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছিল, আগস্ট মাসে ভারতীয় অর্থোপেডিক ডাক্তার Aswani Maichand ঢাকায় আসবেন। তবে আগস্টের উত্তাল সময়ে শেষ পর্যন্ত এই চিকিৎসক ঢাকায় এসেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে আর কোন আপডেট জানানো হয়নি। এরপর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত আর কোন ভারতীয় চিকিৎসককে বাংলাদেশে আনার ঘোষণা দিয়ে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ এক পোস্টে ঘোষণা দেয়া হয় Aswani Maichand মার্চ মাসে বাংলাদেশে আসবেন এবং ফ্রি ওপিডি ক্যাম্প করবেন। বাংলাদেশি একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে রোগীদের দ্রুত এপয়েন্টমেন্ট বুক করতে বলা হয় ওই পোস্টে। এরপর জুন, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে বেশ কয়েকজন ভারতীয় চিকিৎসককে বাংলাদেশে এনে ফ্রি কনসালটেশন ক্যাম্প পরিচালনার ক্যাম্পেইন করেছে এআইএমএস হেলথ কেয়ার।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট করা বিজ্ঞাপন

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট করা বিজ্ঞাপন | ফেসবুক

তবে এসব ক্যাম্প কোথায় পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে পোস্টগুলোতে কখনও কিছু উল্লেখ করা হয় না। রেজিস্ট্রেশনের জন্য দেয়া নম্বরে কল করলে রোগী নাম, বয়স ও যোগাযোগের নম্বর নিয়ে বলা হয়, পরে ক্যাম্পের স্থান জানিয়ে দেয়া হবে।

 

পুলিশ হাসপাতালে আবারও ভারতীয় হেলথ ক্যাম্প?

গত জুন মাসের ১৮ তারিখ এআইএমএস’র একটি পোস্টে জানানো হয় জুন মাসেই ড. বি সাইফানি চন্দ্র নামের একজন চিকিৎসক ঢাকায় আসবেন।ইংরেজিতে পোস্টটি ছিল এমন: “Meet Dr. B. Saiphani Chandra , a leading orthopedic surgeon from KIMS Hospital Hyderabad, Visiting Dhaka this June. Registration now , Seats are limited.”

এ বছরের জুন মাসে ডা. সাইফানি আসার ব্যাপারে পোস্ট করা বিজ্ঞাপন

এ বছরের জুন মাসে ডা. সাইফানি আসার ব্যাপারে পোস্ট করা বিজ্ঞাপন | ফেসবুক

একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে রোগীদের রেজিস্ট্রেশন করতে আহ্বান করা হয়। পরবর্তীতে ২৭ জুন দুপুরে এআইএমএস হেলথ কেয়ার-এর ফেসবুক পেইজে তিনটি ছবি পোস্ট করে ইংরেজিতে ক্যাপশন দেয়া হয়, “Beginning…” (শুরু হচ্ছে)।

এআইএমএস’র পেইজে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভারতীয় ডাক্তার সাইফানি রোগী দেখছেন | ফেসবুক

পোস্টে যুক্ত করা একটি ছবিতে দেখা যায়, একটি হাসপাতালের ভেতরে অনেক রোগী লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, একটি কক্ষে ডাক্তার সাইফানি চন্দ্র রোগী দেখছেন।

এই ছবি দুটি যে ঢাকারা রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে তোলা তা হাসপাতালটির ভেতরকার ওপেন-সোর্স ছবির সাথে মিলিয়ে এবং ওই হাসপাতালে দায়িত্বপালন করা একজন পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে দ্য ডিসেন্ট।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডিআইজি সায়েদুর রহমান দাবি করেন, পুলিশ হাসপাতালে বিদেশি কোন ডাক্তার এসে ক্যাম্প পরিচালনা করার ঘটনা ঘটেনি।

হাসপাতালটির এডমিন ও ফিন্যান্সের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবিরও দাবি করেন, বিগত এক বছরে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে এ ধরণের কোন ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়নি।

তিনি বলেন, “আগে এরকম ক্যাম্প হয়েছিল বলে আমরা শুনেছি। তবে ৫ আগস্টের পর এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি। কেউ অনুমতির জন্য আবেদন করেনি আমরা অনুমোদনও দেইনি।”

এআইএমএস হেল্থ কেয়ার-এর পেইজ থেকে পোস্ট করা ছবি দুটি পাঠিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে রোগী অপেক্ষমান থাকা ছবিটি পুলিশ হাসপাতালের বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। তবে কক্ষের ভেতরের ছবিটি (যেটিতে ডাক্তার সাইফানি চন্দ্রকে রোগীদের সাথে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে) পুলিশ হাসপাতালের কিনা সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করে বলতে হবে বলে জানান তিনি।

একটু পর তিনি ফোন করে দাবি করেন, ছবিগুলো পুরোনো। রোগীদের সাথে প্রতারণা করার জন্য নতুন করে পোস্ট দেওয়া হয়েছে এআইএমএস’র ফেসবুক পেইজ থেকে। এখন থেকে এআইএমএস হেলথ কেয়ারকে পুলিশ হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হবেনা বলেও জানান তিনি।

পরে দেখা যায়, এআইএমএস হেলথ কেয়ার-এর পেইজ থেকে এই ছবিগুলোসহ ভারতীয় ডাক্তারদের নিয়ে যত বিজ্ঞাপন অতীতে দেয়া হয়েছে সবগুলোই সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

 

মুগদা সরকারি হাসপাতালেও ক্যাম্প?

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে একাধিকবার এআইএমএস’র পেইজ থেকে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় যে, ৬ ও ৭ নভেম্বর ঢাকায় রোগীদের ফ্রি কনসাল্টেশন দেবেন ‘ভারতের শীর্ষস্থানীয়’ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ‘হরিশ কুমার কে’। সময়ও উল্লেখ করা হয় ৬ নভেম্বর বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং ৭ নভেম্বর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা। তবে কোন বিজ্ঞাপনেই ঢাকায় কোন হাসপাতালে রোগীদের সাথে বসবেন এই তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। দ্য ডিসেন্ট এর পক্ষ থেকে ৭ নভেম্বর একাধিকবার বিজ্ঞাপিত নম্বরে কল করা হলে কেউ রিসিভ করেনি। বিকাল ২টা ৫৫ মিনিটে এক পরুষ ব্যক্তি কল ধরলে ‘একজন রোগীর এটেন্ডেন্ট’ পরিচয় দিয়ে হেলথ ক্যাম্পের স্থানটি কোথায় জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ওইদিনের ক্যাম্পটি মুগদা সরকারি হাসপাতালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আরও জানানো হয়, ক্যাম্পটি বিকাল ৪টা পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও ৩টার একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে।

“আমরা মাত্র শেষ করলাম। ডাক্তার এখন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। আজকে উনি মুগদা সরকারি হাসপাতালে বসেছেন। এই মাসের শেষে আবার আসবেন। তবে উনি এখানে চিকিৎসা দেন না। শুধু পরামর্শ দেন”, বলেন ওই পুরুষ কণ্ঠ। এর বেশি কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

এআইএমএস হেলথ কেয়ার-এর পেইজে ৫ নভেম্বর করা আরেক পোস্টে জানানো হয়, চলতি নভেম্বর মাসেই ডাক্তার অশ্বিনী মইচান্দ (Aswani Maichand) ঢাকায় আসবেন। এপয়েন্টমেন্টের জন্য যে নম্বরটিতে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে, সেটিতে রোগী পরিচয়ে যোগাযোগ করলে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয় অশ্বিনী মইচান্দ ২০ নভেম্বর ঢাকায় আসার কথা ছিল। তবে সরকার তার অনুমোদন বাতিল করায় তিনি কিছুদিন পর অনুমোদন পেলে আসবেন।

তবে অশ্বিনী মইচন্দের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে গত ৮ নভেম্বর করা একটি পোস্টে জানানো হয়েছে যে, তিনি ২০ থেকে ২২ নভেম্বর ঢাকায় অবস্থান করে ৩০০ জন রোগী দেখবেন। সেখানে তার আসার বিষয়টি স্থগিত হওয়ার কোন তথ্য নেই।

এআইএমএস এর পক্ষ থেকে দ্য ডিসেন্টকে অশ্বিনী মইচন্দের আসন্ন ঢাকা সফর বাতিলের কথা বলা হলেও অশ্বিনীর নিজের ফেসবুক পেইজে এখনও দেখা যাচ্ছে তিনি ২০ নভেম্বর ঢাকায় এসে ৩ দিনের ক্যাম্প করবেন

এআইএমএস এর পক্ষ থেকে দ্য ডিসেন্টকে অশ্বিনী মইচন্দের আসন্ন ঢাকা সফর বাতিলের কথা বলা হলেও অশ্বিনীর নিজের ফেসবুক পেইজে এখনও দেখা যাচ্ছে তিনি ২০ নভেম্বর ঢাকায় এসে ৩ দিনের ক্যাম্প করবেন | ফেসবুক

ভারতের যে ডাক্তাররা ঢাকায় আসেন এআইএমএস’র মাধ্যমে তারা কোথায় রোগী দেখেন জানতে চাইলে এপয়েন্টমেন্ট দেয়া এআইএমএস’র কর্মকর্তা বলেন, “একেকবার একেক জায়গায় বসেন। সর্বশেষ যে ডাক্তার এসেছেন তিনি কোথায় বসেছেন জানতে চাইলে বলা হয়, “একেকবার একেক জায়গায়। সরকারি কর্মজীবি হাসপাতালে রোগী দেখেছেন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও দেখেছেন।”

যে নাম্বারটিতে দ্য ডিসেন্ট-এর প্রতিবেদক রোগী পরিচয়ে যোগাযোগ করেছেন সেটি মূলত এআইএমএস হেলথ কেয়ার (বাংলাদেশ শাখার)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকুর রহমান দীপুর।

ভারতীয় যেসব ডাক্তারদের বাংলাদেশে এনে হেলথ ক্যাম্প করা হচ্ছে তাদের কি বিএমডিসির অনুমোদন রয়েছে কিনা জানতে সাংবাদিক পরিচয়ে তার সাথে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তার মুঠোফোনে পাঠানো ক্ষুদে বার্তারও কোন জবাব দেননি।

তবে এআইএমএস’র ফেসবুক পেইজ থেকে হরিশ কুমার কে এবং অশ্বনী মইচন্দ-এর ঢাকা সফর সংক্রান্ত সব বিজ্ঞাপন ডিলিট করা হয়েছে। পাশাপশি অতীতের একইরকম সব বিজ্ঞাপনও মুছে ফেলা হয়েছে।

দীপুর উল্লেখ করা সরকারি কর্মজীবি হাসপাতাল নামে কোন হাসপাতাল নেই। রয়েছে সরকারি কর্মচারি হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আ. রাজ্জাক সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিগত ছয় মাস/এক বছরে তার হাসপাতালে বিদেশি ডাক্তার আসার বা এ ধরণের কোন ক্যাম্প পরিচালনার ঘটনা ঘটেনি। 

এ ব্যাপারে জানতে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুর রহমানের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি সামনাসামনি গিয়ে কথা বলতে বলেন। মুঠোফোনে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন শুনতেই অস্বীকৃতি জানান তিনি।

জানতে চাইলে বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, “বিদেশি ডাক্তাররা যদি বাংলাদেশে রোগী দেখতে চায় তাহলে সরকারের কাছে অনুমতি নিতে হবে। এটা দুই ক্যাটাগরিতে হয়। একটা হলো ভলান্টিয়ারি, আরেকটা হলো টেকনোলজি ট্রান্সফার। ভলান্টিয়ারি হলে অনুমোদনের জন্য সরকারকে ফি দিতে হবে না। তবে দুই ক্ষেত্রেই অনুমোদন নিতে হবে। আবেদন করলে তখন আমরা যাচাই করি এটা কি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নাকি সেবা হিসেবে। অনুমোদন ছাড়া বিদেশি ডাক্তারদের চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টি যখনই আমাদের চোখে পড়ে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিই।”

 

বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণাও করা হয়

এআইএমএস হেলথ কেয়ার-এর ফেসবুক পেইজ ঘেটে দেখা গেছে, পেইজটিতে শুধু ভারতীয় চিকিৎসকদের বিজ্ঞাপন ও ইতিবাচক দিকই প্রচার করা হয় না। বরং বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণাও চালানো হয়।

যেমন ২০২১ সালের  একটি পোস্টে বর্ণনা করা হয়েছে কেন ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশের চেয়ে ভারত ভালো।

পোস্টটিতে বলা হয়, “ইন্ডিয়ায় ক্যান্সার নিয়ে গবেষনা শুরু হয় টাটা মেমোরিয়াল মুম্বাই এর হাত ধরে ১৯৪১ সালে।যা বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে ক্যান্সার ইন্সটিটিউট (মহাখালী) হাসপাতালে শুরু হয়। এই ৪১ বছরে ইন্ডিয়ার ক্যান্সার চিকিৎসা অনেক এগিয়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতাই তাদের ক্যান্সার চিকিৎসার মূলমন্ত্র। আমরা যতই চেষ্টা করি এই ৪১ বছরের অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলতে পারবোনা। তাদের প্রায় সব হাসপাতালেই ক্যান্সার চিকিৎসা হয় অভিজ্ঞ বোর্ডের মাধ্যমে যেখানে বাংলাদেশে একজন চিকিৎসকের মাধ্যমেই চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়। বাংলাদেশে ক্যান্সার বিশেষায়িত হাসপাতাল হাতে গোনা,৩/৪।যাও আছে সেখানে ভালো ডাক্তার থাকলেও ভালো যন্ত্রপাতি ও রোগীর চাপ বেশি থাকায় মানসম্মত চিকিৎসা নাই বল্লেই চলে। বাংলাদেশে শুধু বিকন ছাড়া আমার কাছে (নিজস্ব মতামত) অন্য কম্পানির ঔষধ গ্রহনযোগ্য মনে হয় না। তাছাড়া অনেক সময় কেমোর মধ্যে লোকাল ডিস্ট্রিবিউটাররা ভেজাল দেয়।”

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি মিডিয়াতে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংক্রান্ত নেতিবাচক খবরও পোস্ট করা হয় পেইজটিতে। 

বাংলাদেশ টাইমস নামের একটি সংবাদমাধ্যম এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিয়ে “চিকিৎসার নামে ডা/কা/তি? এভার কেয়ারের বিলের নামে প্রতারণা” শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। খবরটি শেয়ার দেওয়া হয় এআইএমএস হেল্থ কেয়ারের পেইজ থেকে। 

পাশাপাশি ভারতের বাইরে অন্য দেশে কেন বাংলাদেশি রোগীদের যাওয়া উচিত না সেসব নিয়েও লেখালেখি করা হয় এই পেইজে। 

 

”বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক”

বাংলাদেশি রোগীদের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত ফ্রি ক্যাম্পকে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে বাধা মনে করেন স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা।

চিকিৎসক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার মনে করেন, এগুলো আসলে ফ্রি হেলথ ক্যাম্প নয়। বরং বিদেশি হাসপাতালগুলোর রোগী জোগাড়ের উপায়।

তিনি বলেন, "এটা বিদেশি হাসপাতালগুলোর প্রোমোশনাল ক্যাম্পেইন। রোগীদের এক্সপ্লোয়েট করার একটা উপায়। অনেক সময় ডাক্তাররা এসব ক্যাম্পের জন্য আসেন না। হাসপাতালের কর্মকর্তা বা মালিকরা আসেন। আমরা কয়েকবছর আগে এমন একটি ঘটনা পেয়েছিলাম।"

জনাব তুষার আরও বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে বিদেশ থেকে আসা চিকিৎসকদেরকে অবশ্যই বিএমডিসির নিয়ম মেনে অনুমতি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া উচিত। যদি বিদেশি কেউ ভুল চিকিৎসা দিয়ে থাকে তাহলে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যও ওই চিকিৎসকের নিবন্ধন থাকতে হবে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দ্য ডিসেন্টকে বলেন, “প্রথমত বিদেশি ডাক্তাররা যদি বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা দিতে চান তাহলে তাদের অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু বিদেশি চিকিৎসকদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি হয় রোগীদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া তাহলে এটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অর্থনীতির জন্য খারাপ। আমাদের রোগীরা বিদেশমুখী হলে যেমন বিপুল টাকা বিদেশে চলে যাবে তেমনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠবে। সরকারের উচিত এখানে হস্তক্ষেপ করা।”

তিনি আরও বলেন, ”যেখানে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা আমাদের এখানে পড়তে আসে, নেপাল-ভুটান থেকে আসে, ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশ থেকে মেডিকেল পাশ করে গিয়েছেন, মালয়েশিয়া থেকে একসময় শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে পড়তে আসতো, সেখানে আমাদের রোগীরা কেন চিকিৎসা নিতে ভারত যাবে? চাইলে আমরাও আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পারে। ক্যাপাসিটি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমরা নিয়ে আসতে পারি।”