ধবধবে সাদা কাশফুল। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরে রোদের আলোয় ঝলমল করা শ্বেতশুভ্র কাশবন যেন এক টুকরো স্বর্গ। তবে এই নির্মল সাদা কখনো কখনো লাল হয়ে ওঠে রক্তের রঙে, যখন শান্ত প্রকৃতির বুকে শুরু হয় দখলদারিত্বের খেলা। এই দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই রক্তাক্ত হয় পদ্মার চরের মানুষ ও ধবধবে কাশফুলগুলো। পদ্মার স্রোতের গর্জনে চাপা পড়ে যায় স্বজন হারানোদের কান্নার শব্দ।
পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর ও রাজশাহী জেলার পদ্মা নদীর চরে জেগে ওঠা কাশবন থেকে পাওয়া খড় কেনাবেচার বাণিজ্য দীর্ঘদিনের। বিনা চাষ ও বিনা খরচে এই কাশ বিক্রিতে সবটুকুই লাভ। প্রতি বছর এই চার জেলার চরে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার খড় কেনাবেচা হয়। তবে কাশ বা খড়ের মূল হকদার ওই জমির মালিক অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থেকে যায় কেনাবেচার প্রক্রিয়া থেকে। কখনো আবার সব কিছুর মালিক বনে যান বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। এসব বাহিনীর অগোচরে কখনো বিক্রি হলেও নদীতে খড় ভর্তি নৌকা আটকে টাকা দাবি করেন তারা। নৌকা প্রতি ৫-৬ হাজার টাকা দিতে হয় চর নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর সদস্যদের।
পদ্মার চরে বালুর ওপরে জন্মানো কাশবন থেকে পাওয়া খড়ের বেশিরভাগ পানচাষিদের পানের বরজে ছাউনি তৈরিতে কাজে লাগে। রাজশাহী জেলার পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা এলাকার পানের বরজে এই খড়ের বেশ চাহিদা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলার ৯টি উপজেলায় ৪ হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হচ্ছে। এর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৬৮১ টন। এই পানচাষ পুরোটাই খড় নির্ভর। এই সব উপজেলার পান চাষিদের কাছে একমাত্র ভরসা পদ্মার চর থেকে পাওয়া খড়। পদ্মার পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর খড় কাটা শুরু হয়। পরে সেগুলো পদ্মার ঘাটে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এক হাজার খড় বিক্রি হচ্ছে ২২ হাজার টাকা দরে। অর্থাৎ এক আঁটি খড়ের দাম ২২ টাকা। মাত্র দুই মাস চলা এই ব্যবসার শেষের দিকে প্রতি আঁটি খড়ের দাম পৌঁছায় ৩০ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত।
মোহনপুর উপজেলার করিশা গ্রামের পানচাষি শামিম রেজা বলেন, পান চাষে বাঁশ ও খড় দিয়ে বরজ তৈরি করা হয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে খড়। এগুলো দিয়ে ছাউনি না দিলে পান চাষ করা সম্ভব না। খড় দিয়ে পান বরজের চালা ও চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয়। এর ফলে রৌদ বা কুয়াশায় পানের পাতা নষ্ট হয় না। এমনভাবে সারাবছর রাখতে হয়। এই খড়গুলো পদ্মার শ্যামপুর ঘাট ছাড়াও বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে কিনে নিয়ে আসা হয়। মূলত এই সব উপজেলার পানচাষিদের একমাত্র ভরসা পদ্মার খড়। অন্য উপায়ে করতে গেলে দ্বিগুণ খরচ হবে। তাই খড় দিয়েই করা হয় পানের বরজ।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে খড় ব্যবসায়ী বলেন, বাঘার আলাইপুর ঘাটে শুধু খড় ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে অন্তত ৪০ জন। তারা চর থেকে খড় কিনে ঘাটে বিক্রি করে। চদ্মার চর থেকে প্রতি আঁটি খড় কেনা হয় ৮ টাকা দরে। এরপর নৌকায় করে সুবিধামতো ঘাটে নিয়ে এসে সেগুলো বিক্রি করা হয়।
খড়গুলো কার থেকে কেনেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট নেই। যার থেকে পাই তার থেকে কিনি। আমরা খড়ের জমির সামনে দাঁড়াই। তখন বিভিন্ন বাহিনীর লোক আসে। মোট কতটুকু খড় হয় এটা হিসেবের পর এরপর দামাদামি হয়। অনেক সময় বাহিনীর লোকজন এসে বলে, খড় কেটে নৌকা বোঝায় করার পরে খবর দিতে। খবর দিলে তারা এসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়।’
আরেক খড় ব্যবসায়ী বলেন, ‘চরে অনেক মানুষের জমি রয়েছে। সেগুলো থেকে খড় কেনা হয়। খড় কেনা বাবদ কাঁকন বাহিনীকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে শুনেছি তারা নাকি খড় মালিকদের টাকা দেয়। জানি না কতটুকু সত্য। তবে এই চরে খড়কে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কোটির টাকার লেনদেন হয়। মারাও যায় অনেকেই।’
রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরগুলোতে কাঁকন বাহিনীসহ ১১টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য দীর্ঘদিনের। তারা চরের বাসিন্দাদের ওপর অত্যাচার করে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে- মন্ডল বাহিনী, টুকু বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, লালচাঁদ বাহিনী, রাখি বাহিনী, শরীফ কাইগি বাহিনী, রাজ্জাক বাহিনী, চল্লিশ বাহিনী, বাহান্ন বাহিনী, সুখচাঁদ বাহিনী ও নাহারুল বাহিনী।
এই খড় ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে গেল ২৭ অক্টোবর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হবিরচরে কাঁকন বাহিনীর গোলাগুলিতে বাঘা উপজেলার নিচখানপুরের আমান মন্ডল ও নাজমুল মন্ডল নিহত হন। পরের দিন ২৮ অক্টোবর হবিরচর থেকে লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, নিহত লিটন কাঁকন বাহিনীর সদস্য। এই হত্যকাণ্ডের পরে মূলত আলোচনায় আসে চরের বিভিন্ন বাহিনীর সক্রিয়তার কথা। এ নিয়ে ভয় ও আতঙ্কে মুখ খুলেতে চায় না চার জেলার চরাঞ্চলের মানুষ।

চারবাসী জানান, বিভিন্ন সময় স্পিডবোট ও বড় নৌকায় করে পদ্মার বুকে চলে সশস্ত্র মহড়া। ভারি ভারি অস্ত্র নিয়ে গুলি ছোড়া হয়। চরের কাশবন, ভূমি দখল, বালু মহল নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে বাহিনীগুলোর দৌরাত্ম পাবনার সাড়া ইউনিয়নের বালুর ঘাট থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর, নাটোরের লালপুর হয়ে রাজশাহী বাঘার আলাইপুর ঘাট পর্যন্ত।
প্রতি বছর ভরা মৌসুমে পানি নেমে যাওয়ার পর পদ্মার বুকে জেগে ওঠে বিস্তীর্ণ চর। এই চরের বিনা খরচের ফসল কাশ বা খড়। নাম প্রকাশ না করা অনুরোধে ব্যবসায়ীদের দাবি, শুধুমাত্র বাঘার উপজেলার চরেই বছরে কাশের খড়ের ব্যবসা হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকার। পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত হয় ৩শ কোটি টাকার বাণিজ্য। বিশাল অংকের এই কারবারে জমির মালিক থাকে উপেক্ষিত। পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে কাকঁনসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।
বাঘার নিচ চকরাজাপুর চরের বাসিন্দা রজব মন্ডলের সাড়ে ১২ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি বলেন, চরের অন্য ফসলগুলো মোটামুটি পাওয়া যায়। তবে সেখানেও ভয় আছে। চরের জমিতে জন্মানো খড়গুলো জমির মালিকরা পায় না। এই খড়গুলো দখল করে বিক্রি করে বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন। খড় বিক্রি করতে নিষেধ বা টাকা দাবি করলে বাহিনীর লোকজন মারধর করে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না।
আরেক জমির মালিক বাচ্চু বলেন, কোনো কোনো জমির মালিককে বাহিনীর লোকজন খুব অল্প টাকা দেয়। দেখা যাচ্ছে ২০ হাজার টাকার খড় হলে তারা জমির মালিকে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়। তবে বেশিরভাগ জমির মালিক জানের ভয়ে জমিতে যায় না। এছাড়া কেউ গোপনে খড় বিক্রি করে দিলে বাহিনীর লোকজন নদীতে নৌকা আটকে চাঁদাবাজি করে। এ কারণে বাইরের খড় ক্রেতারারা জমির মালিকের থেকে খড় কিনতে আগ্রহী না। তারাও বাহিনীর লোকজনদের চেনে। তাদের থেকে খড় কেনে। খড় কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে চরে কোটি টাকা লেনদেন হয়। তাই প্রতিবছরই রক্ত ঝরে পদ্মার চরে।
নীচ খানপুর গ্রামের বাসিন্দা মিঠু সরদার। তিনি গেল ২৭ অক্টোবর গোলাগুলির ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, সেখানে খড় কাটা হচ্ছিল। এক সঙ্গে কয়েকজন ছিলাম। হঠাৎ করে কাঁকন বাহিনী স্পিডবোট থেকেই অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। ওরা গুলি করছে, আমরা গুলির ভয়ে শুয়ে ছিলাম। তারা আটজন ছিল, কিছু না হলেও দুই ঘণ্টা গুলি করেছে।
মিঠু বলেন, প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে। তাকে দেখে নাজমুল চিৎকার দিয়ে উঠে। এসময় আমানকে ধরতে গিয়ে নাজমুলেরও গুলি লাগে। তাদের আটজনের হাতে অস্ত্র ছিল। আমরা তো সাধারণ লোক। আমরা মাঠ দেখতে গিয়েছি। এই মাঠে দেড়শ বিঘা জমি আছে। সেই জমির খড় জোর করে নিয়ে নেয় কাঁকন বাহিনীর লোকজনেরা।
বাঘা উপজেলা কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, কুষ্টিয়ার কাছাকাছি হবিরচরে আমাদের প্রায় ১ হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলে। এই চরে আগে শুধু বাদাম হতো। বর্তমানে সেখানে ধান, গম, ভুট্টা, বাদামসহ ডাল জাতীয় ফসল ফলে। কোনো কোনো চরে চাষাবাদ হয় না, শুধু পড়ে থাকে।
গেল শনিবার (৮ নভেম্বর) রাত থেকে রোববার (৯ নভেম্বর) সকাল পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএনের প্রায় ১ হাজার ২০০ জন সদস্য কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর ও রাজশাহী পদ্মার চরে ‘অপারেশন ফাস্ট লাইট’ অভিযান পরিচালনা করে। এসময় ৬৭ জনকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার পদ্মার চর থেকে ১৪ জন, নাটোর থেকে ২০ জন, পাবনা থেকে ২৪ জন এবং কুষ্টিয়া থেকে ৯ জন রয়েছে।
রোববার (৯ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, অভিযানে মোট ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় ১০টি অস্ত্র, চার রাউন্ড গুলি, দুইটি গুলির খোসা, ২৪টি হাসুয়া, ৬টি ডেসার, ২টি ছোরা, ৪টি চাকু, ৩টি রামদা, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ২০ বোতল ফেসনিডিল, ৫০ পিস ইয়াবা, ৮০০ গ্রাম গাঁজা, ৫টি মোটরসাইকেল ও একটি লোহার পাইপ উদ্ধার করা হয়েছে। চরাঞ্চলে শান্তি ফেরাতে এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাঘা উপজেলার চকরাজাপু ইউনিয়নের ৮ নম্বর মেম্বার তন্চু মোল্লা বলেন, চরের খড়ের টাকা জমির মালিক পায় না। সব খড় বিভিন্ন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখনও আছে। এক বিঘা জমিতে দুই থেকে তিন হাজার খড় হয়। ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে কেনাবেচা হয়। চরের কাশি এখনও বিভিন্ন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। প্রতিবছর খড় ও চরের জমি দখলকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরে। এই বছরও রক্ত ঝরেছে।