জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী ইমরান আহমেদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষ করা হয়েছে। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আবু সাঈদের মৃত্যু হয়, সহযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি তাদের প্রত্যেকের শাস্তি দাবি করছি।’
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে ১৩তম সাক্ষী তার জবানবন্দি পেশ করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
জবানবন্দি পেশ করার পর সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। এরপর জেরা ও সাক্ষী গ্রহণের জন্য এই দিন ঠিক করেন আদালত।
সাক্ষী তার জবানবন্দিতে বলেন, আমার নাম ইমরান আহমেদ। আমার বর্তমান বয়স প্রায় ২৭ বছর। আমি রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করি।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে রংপুর নগরীর ৪ তলা মোড় এলাকা থেকে আমরা একটি মিছিল নিয়ে মডার্ন মোড় অভিমুখে যাত্রা শুরু করি। পথে নগরীর লালবাগ এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রসহ আমাদের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা সংখ্যায় বেশি থাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। আমরা আবারও স্লোগান দিতে দিতে যাত্রা শুরু করি।
সাক্ষী বলেন, দুপুর ১টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট পার হয়ে ১ নম্বর গেটের (বর্তমানে আবু সাঈদ গেট) কাছাকাছি পৌঁছাই। পৌঁছানোর পর ২টার দিকে প্রথমে পুলিশ আমাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা বাধা উপেক্ষা করে স্লোগান দিতে থাকি। একপর্যায়ে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়ায় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করা শুরু করে এবং অতর্কিতভাবে লাঠিচার্জ করা শুরু করে। সে সময়ে প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-ওদিকে ছোটাছুটি করে।
এই শিক্ষার্থী বলেন, এসময় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মাথার পেছনে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং রক্ত পড়া শুরু হয়। এ পর্যায়ে আমাদের আক্রমণকারী পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের ভেতরে অবস্থান নেন এবং ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সাক্ষী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছাত্রলীগের পোমেল বড়ুয়া, মাহফুজ, আরিফ, বাবুল, টগর, ফজলে রাব্বী, আক্তার, আকাশ, মাসুদ রানা ও সেজান মাহমুদসহ রংপুর মহানগর, জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ এর অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আগে থেকে অবস্থান নেন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কোনো ভূমিকা রাখেনি বা অবৈধভাবে অবস্থানরত বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি।
উপরন্তু প্রক্টর ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর চলে যায়। শিক্ষকদের মধ্যে মশিউর রহমান ও আসাদ মন্ডল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রাফিউল হাসান রাসেল, মনিরুজ্জামান পলাশ, হাফিজুর রহমান তুফান, কর্মচারীদের মধ্যে নুরুন্নবী, নূর আলম, মাহবুবুর রহমান, আমির হাসান আমু, আনোয়ার পারভেজ আপেল ভেতরে অবস্থান নিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এমতাবস্থায় দুপুর ২টার পর আমাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি অংশ গেট খোলার চেষ্টা করে। তখন ভেতরে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এবং পুলিশ কর্মকর্তা এসি আরিফ, এসি ইমরান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাড়ির ইনচার্জ বিভূতী ভূষণ রায়, তাজহাট থানার ওসি রবিউলসহ সবাই মিলে ভেতর থেকে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ঢিল ছুড়ে।
পুলিশ কর্মকর্তারা ভেতর থেকে গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসতে থাকেন। তখন গেটের সামনে অবস্থান করা ছাত্ররা আবারও ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি শুরু করেন। এ অবস্থায় আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যায় এবং গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর একটু পিছিয়ে গেলে আবারও গুলিবিদ্ধ হয়। তখন আবু সাঈদ ডিভাইডার পার হয়ে একটু পেছনে আসে।
আরেকটু পেছনে থাকা আয়ান এগিয়ে এসে আবু সাঈদকে ধরে। তারপর একটু সরে যাওয়ার পর সাজু রায়সহ আরও কয়েকজন আবু সাঈদকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমরা আনুমানিক এক ঘণ্টা পর খবর পাই যে, হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক আবু সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি যে, তৎকালিন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, ডিসি ক্রাইম আবু মারুফ, এডিসি ডিবি শাহ নুর আলম পাটোয়ারী, এসি আরিফ, তাজহাট থানার ওসি রবিউলের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান, আসাদ মন্ডল, কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, হাফিজুর রহমান তুফান এবং মনিরুজ্জামান পলাশের সহযোগীতায় এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্রের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়।
যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগীতায় আবু সাঈদের মৃত্যু হয়, সহযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি তাদের প্রত্যেকের শাস্তি দাবি করছি।