Image description

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৈয়ারচালা গ্রামে ফসলি জমির মাঝে জুলহাস মিয়ার বাড়ি। ছোট এক খণ্ড জমিতে টিনের ঘর, মাটির মেঝে। সেখানে ডুকরে কাঁদছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। তাঁকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন ১৮-২০ বছরের এক মেয়ে। কাছে গিয়ে জানা গেল, তারা জুলহাস উদ্দিনের মা সাজেদা আক্তার ও বোন ময়না আক্তার।  

সাজেদা আক্তার বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তাহলে কী কারণে তাকে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো? এখন আমি কী খেয়ে বাঁচব? কিস্তি দিতে না পারলে তো লোকেরা আমাকে জেলে ভরবে। আল্লাহ ছাড়া এখন আমাদের কেউ নাই।’
জুলহাসের মা বলছিলেন তিনটি এনজিও থেকে নেওয়া তিন লাখ টাকা ঋণের কিস্তির কথা। বছরখানেক আগে এনজিও এবং স্বজনদের কাছ থেকে আরও তিন লাখ টাকা ধার করে নতুন বাড়ি করেন বাসচালক জুলহাস উদ্দিন। সেই ঋণ এখনও শোধ হয়নি। এর মধ্যেই গত সোমবার দিবাগত রাতে বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা জুলহাস পুড়ে মারা যান।

মায়ের কেনা জমিতে ঘর তোলার পর বিয়ে করেছিলেন জুলহাস। স্ত্রী জাকিয়া আক্তার এক বছরের মধ্যেই এখন বিধবা। তিনি জানান, ৫ শতাংশের একটি ভিটামাটি ছাড়া আর সম্পত্তি বলে কিছু নেই। এখন কে নেবে তাদের দায়িত্ব?

দীর্ঘদিন বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পর পাঁচ মাস যাবৎ চালক হিসেবে কাজ করছিলেন জুলহাস। অল্প আয়েই চলছিল তাদের নতুন সংসার। মাসে সব মিলে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় হতো তাঁর। এই টাকা দিয়েই ৩-৪ জনের সংসার চালাতেন তিনি। মাঝে মাঝে ছোট বোন ময়নাকেও সহায়তা করতেন। আগেই বাবা মারা গেছেন। তাই বার্ধক্যে উপনীত মায়ের সংসারে এখন আর কোনো উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। 

পরিবার ও এলাকাবাসী জানান, ‘আলম এশিয়া’ পরিবহনের চালক ছিলেন জুলহাস। ভালুকজান ইসলাম পেট্রোল পাম্পের কাছে গত সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে পেট্রোল ঢেলে বাসটিতে আগুন দেওয়া হয়। চালক জুলহাস বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
ছোট বোন ময়না আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাই আমগোর সংসারের একমাত্র ভরসা। আমার ভাই তিনটা কিস্তি চালাইত। এহন কিস্তি চালানোর টাকা কই পাইয়্যাম? সংসারই বা কেমনে চলবো? আমরা কারে ভাই ডাকমু গো; কেডা আমার মারে এহন খাওয়াইবো গো।’ ময়নার স্বামী সাঈম হোসেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম।

প্রতিবেশী স্বপন বলেন, জুলহাসের উপার্জনেই গোটা পরিবার চলত। এই নিরীহ ছেলেটি চলে যাওয়ায় পরিবারটি পথে বসবে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, এক মুহূর্তে একটি পরিবার চরম অসহায়ত্বের মুখে পড়ে গেছে। মা, বোন ও স্ত্রী– এই তিন নারীর জীবন পুরোপুরি অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। অসহায় পরিবারটির জন্য সরকারের সহযোগিতা ও সমাজের মানবিক সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।
​বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ময়মনসিংহের মোটরযান পরিদর্শক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, জুলহাস মিয়া নিবন্ধিত চালক ছিল কিনা– এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে। যদিও এটি নাশকতা, তবুও সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী নিহত চালকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক সহায়তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। আমরা দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে পরিবারটিকে সংশ্লিষ্ট সরকারি কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য পাইয়ে দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করব।