রাজধানীর মিরপুরের গৃহবধূ সালমা বেগম (৩৫) জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খান। কিছুটা সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে আবার জ্বর আসে। এরপর দ্রুত প্রেশার কমে যায়, প্লাটিলেট নেমে যায় বিপজ্জনক পর্যায়ে। হাসপাতালে নেওয়ার পর আইসিইউতে তিনদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। গত ৮ অক্টোবর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মারা যান তিনি।
একই অবস্থার শিকার তিনবারের বিশ্বজয়ী হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকী (২৫)। ডেমরার বাসিন্দা ত্বকী বিদেশে পড়াশোনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সপ্তাহখানেক আগে জ্বর শুরু হলে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খান। কিছুটা উন্নতির পর আবার জ্বরসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পাঠানো হয় রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরদিনই আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। গত মঙ্গলবার সেখানেই মারা যান তিনি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের এমন আকস্মিক মৃত্যু নিয়ে বিস্মিত চিকিৎসকরাও। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর বর্তমান ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট আগের চেয়ে অনেক আক্রমণাত্মক। রোগীর শরীরে দ্রুত শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে এবং ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টে সামান্য ভুলও প্রাণঘাতী হচ্ছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান হোসেন মালিথা আমার দেশকে বলেন, ‘মূলত ডেঙ্গুর আচরণ পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে। এবারের ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) অন্যবারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এবার তরুণরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছে এবং আক্রান্ত হলেই দ্রুত শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে। প্রথম দফায় সামান্য জ্বর সেরে যাওয়ায় রোগীরা অসচেতন থাকছেন কিন্তু শরীরের ভেতরে প্লাটিলেট ও অক্সিজেন স্যাচুরেশনের অবনতি হয় অজান্তে। রোগীর পাশাপাশি চিকিৎসকরাও এটি ধরতে পারেন না। ফলে দ্বিতীয় দফায় সামান্য জ্বর হঠাৎ গুরুতর পর্যায়ে চলে গেলে সেখান থেকে স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসা কঠিন হয়ে যায়। বর্তমানে দ্রুত শনাক্ত করা এবং ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার ৫১৩ ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৬৫১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এদিন তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে মৃতের সংখ্যা ২৭৮ জনে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬২ শতাংশ এবং মোট মৃত্যুর ৫৩ শতাংশই পুরুষ।
ভর্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বেশিরভাগ মৃত্যু
চলতি বছর ডেঙ্গুতে যেসব রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তার ৬৮ ভাগই ঘটেছে ভর্তির ৭২ ঘণ্টা বা তিনদিনের মধ্যে। এছাড়া ৪৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। দেরিতে হাসপাতালে আসায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।
গত ২২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিম-উর রশিদ বলেন, ‘এখন রোগীরা হাসপাতালে এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন। শিশু ও বয়স্কদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম আবার অনেকের একাধিক জটিল রোগ থাকায় মৃত্যুঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকায় আক্রান্তদের বেশিরভাগই চার এলাকার
রাজধানীর যে কয়টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। চলতি বছরের এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৬৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে। এখনো চিকিৎসাধীন ১৭৬ জন। হাসপাতালটিতে মারা গেছেন ৩৯ জন। এ হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীই এসেছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মান্ডা, বাসাবো এবং খিলগাঁও এলাকা থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সিংহভাগই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত। প্রথমবার আক্রান্তে সঠিক সময়ে ডায়াগনোসিস ও যথাযথভাবে ফ্লুইড ম্যানজমেন্ট না হলে পরে ওই রোগী দ্রুত শকে চলে যায়। ফলে তাকে ফেরানো কঠিন হয়ে যায়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ আমার দেশকে বলেন, অধিকাংশ রোগী এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে ভুগছে, যা লিভার, কিডনি ও হৃদযন্ত্রকে একসঙ্গে আঘাত করছে। ফলে হাসপাতালে নেওয়া হলেও খুব দ্রুত অবস্থা খারাপ হচ্ছে, বেশি কিছু করা যাচ্ছে না। আর কোনো রোগী শকে চলে গেলে তাকে ফেরানো কঠিন। জ্বর দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা, তরল খাবার গ্রহণ এবং সঠিক ফ্লুইড ব্যবস্থাপনাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সফটওয়ার প্রস্তুত, তবু মিলছে না আক্রান্তের তথ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য দিলেও মোট কতজন ডেঙ্গু পরীক্ষা করছেন বা কতজন শনাক্ত হচ্ছেন, তার কোনো তথ্য নেই। এজন্য ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্রও অজানা থেকে যাচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর একটি সফটওয়্যার তৈরি হলেও তা এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরশেন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অপারেশন প্ল্যান বন্ধ থাকায় নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ আটকে গেছে। ফলে সফটওয়্যার চালু করা সম্ভব হয়নি।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা চালুর পরামর্শ
যেহেতু শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও ডেঙ্গুর বিস্তার করেছে এবং মশাবাহিত ভাইরাসটির আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর আচরণ পরিবর্তনে এখন কেউ আক্রান্ত হলেও বোঝার উপায় থাকে না। তাই প্রত্যন্ত এলাকায়ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ মানুষ শহরে এসে পরীক্ষা করবে না, তাদের বাড়ির কাছেই এ সুবিধা থাকতে হবে।