
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নির্বাচনগুলোতে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় নামায় দেশে-বিদেশে চরম ইমেজ সংকটে পড়ে পুলিশ। সেই কলঙ্ক মুছে বর্তমানে নতুন ইমেজ সৃষ্টির চেষ্টা করছে পুলিশ। এরই অংশ হিসাবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সব সদস্যকে শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রতিটি থানা এলাকার সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের ঝুঁকি নিরূপণের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে পুলিশ। ঝুঁকি অনুযায়ী সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হবে ঢাকা শহরে। নগরবাসী যেন নির্বিঘ্নে যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে-সেই পরিবেশ নিশ্চিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ওসিদের ভালো ইমেজ ক্রিয়েট করার ওপর জোর দেওয়া, পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সঠিকভাবে পালন করা ও ছিনতাই-চাঁদাবাজি ঠেকাতে আরও কঠোর হতে বলা হয়েছে পুলিশকে।
সোমবার রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে জুলাই-২০২৫ মাসের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় (ক্রাইম কনফারেন্স) ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এসব নির্দেশনা দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে সভাটি চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। এ সময় সভাপতির বক্তব্যে টানা ৩০ মিনিট তিনি উপস্থিত সবাইকে দিকনির্দেশনা দেন। মাসিক অপরাধ সভায় জুলাই মাসে ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও জননিরাপত্তা বিধানসহ উত্তম কাজের স্বীকৃতি হিসাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ডিএমপির বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করেন ডিএমপি কমিশনার। উল্লেখ্য, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন। এর পরই পুলিশের নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
ক্রাইম কনফারেন্সে উপস্থিত এক উপপুলিশ কমিশনার যুগান্তরকে বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিএমপির সব পুলিশ সদস্যকে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করার ওপর জোর দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) ইমেজ ক্লিন করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আপনি হতেই পারেন বিএনপির লোক, জামায়াতের লোক, কিন্তু তা পাবলিকলি প্রকাশ করার দরকার নাই। একটা ইমেজ ক্রিয়েট করেন-যাতে মানুষ বলে ওসি নিরপেক্ষ।’ ডিএমপির থানা এলাকার যেখানে যেখানে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র হবে, সেখানে নিরাপত্তাজনিত কোনো ঝুঁকি আছে কিনা সেগুলো খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে কী কী নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, এগুলো বিশ্লেষণ করতে এখন থেকেই নজর রাখার নির্দেশ দেন । ডিএমপির সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ সদস্য নির্বাচনে মোতায়েন করা হবে বলে জানানো হয় সভায়।
ডিএমপি সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, সামনে নির্বাচন ঘিরে এখন থেকেই পুলিশ সদস্য মোতায়েনের জন্য প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে। থানার ওসিদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, আপনারা নির্বাচন কমিশন থেকে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্রের লিস্ট কালেক্ট করবেন। থানা থেকে কেন্দ্রের দূরত্ব কত এগুলো বিস্তারিত জানবেন-যাতে অপারেশন শাখা ফোর্স বণ্টন করতে পারে। পুলিশ সদস্যদের এখন থেকেই মানসিকভাবে ভোটের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। কোথায় কেন্দ্র হবে, সেখানে সিকিউরিটি সিস্টেম কি হবে, ভোটার কত, কোন এরিয়ায় কত জন ভোটার, এসব তথ্য রেডি করতে হবে। কমিশনার আরও বলেছেন, এবার অবশ্যই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, সুষ্ঠু হবে-এ ধরনের প্রস্তুতি নেন আপনারা।
শতভাগ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছেন তিনি। মানুষ বহু বছর ভোট দিতে পারে না, তারা যেন শান্তিমতো যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দিতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ডিএমপির এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
এছাড়া পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে আরও মনোযোগী হতে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন কমিশনার। বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযানের মাত্রা আরও বাড়াতে বলা হয়েছে। এরা যেন দৌরাত্ম্য না দেখাতে পারে সেভাবে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন কমিশনার।
সভা সূত্র বলছে, মোটরসাইকেল ব্যবহার করে রাজধানীতে অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে কমিশনার বলেছেন, এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে কাগজপত্রবিহীন মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সভায় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
সভায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমেদ বলেছেন, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস)-এর তথ্য নিয়মিত আপডেট রাখতে হবে। সিআইএমএসের তথ্যের সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ করবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানান, ওয়ারেন্ট তামিল ও চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন, যাতে মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
সভায় যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন জুলাই-২০২৫ মাসের সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি যেমন-ডাকাতি, দস্যুতা, চুরি, সিঁধেল চুরি, খুন, অপমৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন মামলা-সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেন। এ সময় ডিএমপি কমিশনার উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেন।
অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মো. মাসুদ করিম; অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস্, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) হাসান মো. শওকত আলীসহ যুগ্ম পুলিশ কমিশনাররা, উপপুলিশ কমিশনাররা, ডিএমপির সব থানার অফিসার ইনচার্জ ও বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।