Image description
২০ বছরেও রপ্তানি আয়ের অর্থ মেলেনি এফসি অ্যাকাউন্টে

খলাপি ঋণ হিসাবে চারটি ব্যাংক দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘কেয়া কসমেটিক্স লি.’-এর কাছে প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা পাওনা। অপরদিকে রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি মার্কিন ডলার (৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা) ওই ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে কেয়া গ্রুপের ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে (এফসি) জমা করেনি। কারণ, এখন পর্যন্ত এই বিপুল অঙ্কের অর্থের কোনো অস্তিত্ব নেই ব্যাংকগুলোর কাছে। অর্থাৎ একরকম উধাও হয়ে গেছে এই অর্থ। বিপুল অঙ্কের পাওনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং কেয়া গ্রুপ একে অপরের কাছে দাবি করে আসছে। তবে বকেয়া না পেয়ে কেয়া গ্রুপকে খেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে অ্যাকাউন্টে রপ্তানির অর্থ জমা না হওয়ার ঘটনার তদন্ত চেয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে (এফআরসি) চিঠি দিয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা-ব্যাংকগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ২০ বছরের (২০০৩ থেকে ২০২৩) বিভিন্ন সময়ে এই অনিয়মের ঘটনা ঘটে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

অন্তর্বর্র্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেয়া গ্রুপ প্রথম দফায় উল্লিখিত সমস্যা তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেয়া গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, প্রথম দফার চিঠিতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ কারণে আমরা এবার ঘটনার তদন্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছি। আশা করছি, প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক গুরুত্ব সহকারে নির্দেশ দেবে।

সূত্রমতে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা তদন্ত করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি নিরীক্ষা (অডিট) ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। তাদের কার্যক্রম চলমান।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে লেখা চিঠিতে কেয়া গ্রুপ বলেছে, রপ্তানি আয়ের বিপুল অঙ্কের ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা না করায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে কর্মরত প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ও কর্মীর (যার মধ্যে ১০০০ জন প্রতিবন্ধী কর্মী) বেকার হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় ৫০ হাজার শেয়ারহোল্ডার তাদের বিনিয়োগের বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে উল্লেখ করে বিএসইসি এবং এফআরসির চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়।

ওই চিঠিতে কেয়া গ্রুপের পক্ষ থেকে আরও উল্লেখ করা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত চাওয়ায় ব্যাংকগুলো সব ধরনের সুবিধা (আমদানি-রপ্তানি) কার্যক্রম কেয়া গ্রুপের সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ ব্যাংকগুলোর কাছে এ প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত বন্ধক আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের উদ্যোগের কারণে রপ্তানি আয় বন্ধ হয়ে প্রতিমাসে গড়ে ১ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের রিজার্ভ। যদিও এই সংকটকালে রিজার্ভ বৃদ্ধি খুবই প্রয়োজন।

জানতে চাইলে কেয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক পাঠান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের রপ্তানি আয়ের ৬৬ কোটি ডলার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আমাদের এফসি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেনি। এটি করে দিলে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২৭শ কোটি টাকার দায় থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক হিসাবের গরমিল করেছে-এটি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সমগ্র দেশের মোট ডলার হিসাবের জন্য গুরুতর হুমকি। আমার রপ্তানি আয় সম্পূর্ণ ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করতে ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকগুলো বিটুবি/আমদানি পরিশোধের জন্য ফোর্স লোন এবং পরবর্তী সময়ে টার্ম লোনে কনভার্ট করে। এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। কারণ, ব্যাংকের ভুলের কারণে আজ কোম্পানি ঋণখেলাপি এবং কোম্পানি ও দেশ অর্জিত বৈদেশিক মুনাফা থেকে বঞ্চিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, সাউথইস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৪-২০২৩ সাল পর্যন্ত কেয়া কসমেটিক্স বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট বিদেশে পণ্য রপ্তানি করেছে ১০১ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলারের। ব্যাংক এ রপ্তানির পুরো অর্থ আদায় করলেও ৩৯ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার কোম্পানির এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিরপীতে বিটুবি (ব্যাক টু ব্যাক) আমদানি ছিল ৮০ কোটি ডলার। ব্যাংক এই ৮০ কোটি ডলারের হিসাবটি ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরবর্তী সময়ে মেয়াদি ঋণ সৃষ্টি করে।

এ প্রসঙ্গে সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান এমএ কাসেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার পক্ষে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, ব্যাংক অডিট করে দেখছে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সর্বশেষ বিএসইসি এ বিষয়ে একটি অডিট ফার্মকে তদন্তের জন্য নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে অডিট শেষ করেছে; কিন্তু রিপোর্ট এখনো জমা দেয়নি। রিপোর্টটি পেলে আমরা বুঝতে পারব।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেওয়া ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০০৭-২০২৩ সাল পর্যন্ত পূবালী ব্যাংকের মাধ্যমে কেয়া গ্রুপ ২০ কোটি ১৯ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ব্যাংক সে অর্থ আদায় করলেও কোম্পানির এফসি অ্যাকাউন্টে কোনো অর্থ জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি (ব্যাক টু ব্যাক) আমদানি ছিল ৫.৩২ কোটি ডলার। এ হিসাবটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরে মেয়াদি ঋণ সৃষ্টি করে।

বিষয়টি জানতে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত সচিব যোগাযোগ করলেও এ মুহূর্তে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।

এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানির পর সেটি পুরোপুরি আদায় হয়। কিন্তু ব্যাংক ৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করেনি। এই পণ্য রপ্তানির বিরপীতে বিটুবি (ব্যাক টু ব্যাক) আমদানি ছিল ৩.৪৫ কোটি ডলার। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদিল চৌধুরী ‘নো কমেন্টস’ মন্তব্য করেন যুগান্তরের কাছে।

একইভাবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৬৫ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও এফসি অ্যাকাউন্টে কোনো পরিমাণ জমা দেয়নি। এই পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিটুবি (ব্যাক টু ব্যাক) আমদানি ছিল ৪১ লাখ মার্কিন ডলার। এই হিসাবটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফোর্স লোন সৃষ্টি এবং পরে টার্ম লোনে কনভার্ট করে। জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, আমরা ব্যাংকের কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি কেয়া গ্রুপের অভিযোগ ও তথ্য সঠিক নয়। এটি মিস ইনফরমেশন।

অভিযোগ করা হয়েছে, এসব ঘটনার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার বাধ্যবাধকতা এবং ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। যার সার্কুলার নং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এফইপিডি (এএমডিএএনআইএনআইটিআই) ১১৭/২০১৭/-১২.।