
সামিউল সোমবার স্কুলে যেতে চায়নি। মায়ের কাছে আবদার করেছিল আজ সে বাসায় থাকবে। সকালে উঠে ছোটবেলার কটি খেলনা উড়োজাহাজ শোকেস থেকে নামিয়ে মুছে পরিষ্কার করে খেলছিল সামিউল। কিন্তু তার মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে স্কুলে যেতে রাজি করান। এটা জানলে ওকে আমরা স্কুলে পাঠাতাম না...’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সামিউলের মামা সৈয়দ মনির হোসেন।
রাজধানীর উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সামিউল করিমের (১১) মৃত্যুতে পুরো পরিবার শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সামিউলের মা রেশমা করিম গতকাল থেকে দানাপানি মুখে নিচ্ছেন না। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে মুহ্যমান রেশমা এখন কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। বাবা রেজাউল করিম নির্বাক।
নিহত সামিউল বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার খারকি এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে। তাঁর দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে সামিউল ছোট। বড় মেয়েটি এবার একই স্কুল থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে সামিউলের লাশ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে মেহেন্দীগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। সকাল ১০টার দিকে তার নানার নামে প্রতিষ্ঠিত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জানাজা শেষে উপজেলার চানপুর ইউনিয়নের খন্তাখালী গ্রামে নানার বাড়িতে দুপুরে দাফন করা হয় সামিউলকে।
চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু দেখেছেন রেজাউল করিম। তাই যখনই সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন আর ‘বাবা, বাবা...ও আমার বাবা...’ বলে মূর্ছা যান।

বায়িং হাউসের মালিক রেজাউল উত্তরায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। অফিসের কাজে ব্যস্ততা থাকলেও প্রতিদিন সকালে তাঁর দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন আবার দুপুরে বাসায় নিয়ে আসতেন। সোমবার সকালে তিনি ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গেটের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছেলে যখন দোতলার সিঁড়ি বেয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে, তা দেখে বাসায় ফিরে অফিসে যান। বেলা একটার দিকে তিনি আবার স্কুলের গেটে ছেলেকে বাসায় নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। স্কুল ছুটি হয়েছে তখন, সামিউল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে বাবার দিকে আসছিল। বাবা তাঁর পাঁচ ফুট দূরত্বে। ঠিক ওই সময় বিধ্বস্ত বিমানের একটি জ্বলন্ত অংশ সামিউলের পেছনে আঘাত করে। রেজাউল হতবিহ্বল হয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার ছেলেকে বাঁচান, হেল্প...হেল্প।’ ঝলসে যাওয়া ছেলেটা তখনো তাঁর বুকের মধ্যে ছটফট করছিল। একজন সেনাসদস্য তখন তাঁর গায়ের পোশাক খুলে দিয়ে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। রেজাউল ছেলেকে ওই পোশাক দিয়ে পেঁচিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখেন। এর কিছুক্ষণ পরে একটি সামরিক হেলিকপ্টার সেখানে আসে এবং ছেলেকে নিয়ে সিএমএইচে নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। আধা ঘণ্টা পর ভেতর থেকে একজন এসে বললেন, ‘দুঃখিত, আমরা আপনার ছেলের জন্য কিছু করতে পারিনি।’
রেজাউল এসব বর্ণনা করার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেটা জ্বলছিল, আমি কিছুই করতে পারিনি। চোখের সামনে চলে গেল, আহা রে কী যন্ত্রণা না পেল আমার বাপটা...। আমি কীভাবে ওরে ছাড়া থাকব, কীভাবে এই দৃশ্য দেখে সারা জীবন বাঁচব? আমি তো আর জীবনে ঘুমাতে পারব না, সব শেষ হয়ে গেল।’
সামিউল ছিল দাদা ও নানার পরিবারে খুব আদরের। রেজাউল করিমের বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বৃদ্ধ মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বারবার তাঁর মা নাতি সামিউলকে দেখার জন্য ঢাকায় ছেলের কাছে ফোন করতেন। সপ্তাহখানেক আগে পরিবার নিয়ে রেজাউল গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। দাদি তাঁর প্রিয় নাতি সামিউলকে কাছে পেয়ে কী যে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। ১০ থেকে ১২ ধরনের পিঠা তৈরি করেন সামিউলের জন্য।

রেজাউল বলেন, ‘আমার মা তাঁর নাতির জন্য এত খাবার তৈরি করেছিলেন যে ছেলে হিসেবে আমাকেও তিনি এত খাবার তৈরি করে কখনো খাওয়াননি। কে বুঝেছিল এটাই ওর শেষ গ্রামে আসা!’ তিনি বলেন, ‘গত শনিবার যখন গ্রামের বাড়ি থেকে লঞ্চে ঢাকায় যাই, তখন আমার মা নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বিদায় জানান। তখনো বুঝতে পারিনি এটাই ওর শেষ যাত্রা।’
নানা চারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মোস্তফা কামাল হাওলাদারের কবরের পাশে শায়িত শিশু সামিউল। ভাগনের কবর দেখিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে সামিউলের আরেক মামা সাইফুল ইসলাম প্রশ্ন তুললেন, ‘সরকার পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেবে, কিন্তু আমার ভাগনে কেন কবরে? আমি বলব, এটা মারাত্মক অবহেলা, অব্যবস্থাপনার কারণে এতগুলো শিশু আজ মারা গেল, শিশুদের প্রতি এই অবহেলা মানা যায় না।’