Image description
অগ্নিঝরা জুলাই

‘ছোটবেলা থেকে মেয়েটা সবার খুব আদরের ছিল। সবাই ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। ওর স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। সন্তানদের স্বপ্ন পূরণের জন্য ওদের মা বিদেশ গেল। একটা ছোট চায়ের দোকান করে আমিও তাদের স্বপ্ন পূরণে সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। মেয়েদের কখনো অভাব-অনটন বুঝতে দেইনি। আমার অনেক ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে শিক্ষিত করবো। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনাও করাইছি। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হইলো না। আমাদের না বলে পালিয়ে পালিয়ে আন্দোলনে অংশ নিতো। নাফিসাকে এভাবে হারাতে হবে কখনো ভাবিনি। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’ এভাবেই বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাবা আবুল হোসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৫ই আগস্ট সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাফিসা। তিনি গত বছর গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার সাহাজউদ্দিন সরকার স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছিলেন। নাফিসা ৪.২৫ পেয়ে পাস করেন। কিন্তু এক ঘাতক বুলেট কেড়ে নিলো নাফিসা জীবন ও বাবা-মায়ের স্বপ্ন।

শহীদ নাফিসার বাবা আবুল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নাফিসা টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ- ৪ দশমিক ২৫ পেয়ে পাস করে। তার এই ফলাফল সে দেখে যেতে পারেনি। তিনি বলেন, যে জন্য এই গণ-অভ্যুত্থানটি হয়েছিল, সেটি এখনো দেশের মানুষ পাইনি। শহীদেরা যে কারণে জীবন দিয়েছে সেটি হয়তো আগামীতে পেতে পারি। আমরা যদি দেশের প্রতি সবাই আন্তরিক থাকি তবেই দেশ সুন্দর হবে। বর্তমান সরকারের কোনো সদিচ্ছা দেখছি না। এবং যারা দলীয় অন্তর্কোন্দলের মধ্যে আছে তাদেরকে সরকার কন্ট্রোল করতে পারছে না। আমরা তো এমন বাংলাদেশ চাইনি। যারা শহীদ হয়েছে, দেশের জন্য এত আন্দোলন- এত যুদ্ধ করেছে তারা তো এই বাংলাদেশ চাইনি। রাস্তার মধ্যে প্রকাশ্যে পাথর নিক্ষেপ করে মানুষকে হত্যা করতে হবে। মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে ইমামকে আঘাত করতে হবে। আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। সবাই নির্বিঘ্নে বসবাস করবে কোনো চিন্তা ছাড়া। কোনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না। এখনো মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এই সরকারের প্রতি আমাদের একটা আশা ছিল সন্ত্রাসীদের দমনের কিন্তু তিনি তো সেটি পারছেন না। এত শহীদের জীবন কি বৃথা যাবে? গত কয়েক মাসে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এই সরকার যেন থাকাকালীন অবস্থায় কিছুটা হলেও কমপ্লিট করে যায়।

তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সবসময় বাবা-মায়ের কাছে থাকবে, দেশের জন্য কাজ করবে- এই চাওয়াটাই ছিল। এখন মেয়েটি না থাকায় অনুভবই করতে পাচ্ছি না এই দেশের। সে এই দেশটাকে দেখে যেতে পারলো না। ফ্যাসিস্টকে হটালো, আমাদের ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে গেল সেটি তো তারা ভোগ করতে পারলো না। এটাই সবচেয়ে বেশি কষ্টের, বাবা হিসেবে এর চেয়ে আর কিছু কষ্টের হতে পারে না। আমার দুই সন্তান তার মধ্যে নাফিসা বড় ছিল।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরই নাফিসার ফোন থেকে একজন কল দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানায় এবং দ্রুত আমাকে সাভার যেতে বলে। সেদিন অনেক কষ্টে টঙ্গী থেকে বেড়িবাঁধের ধউর পর্যন্ত গিয়ে আর যেতে পারিনি। ৩রা আগস্ট থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় থাকতো নাফিসা।
আবুল হোসেন বলেন, নাফিসা সবসময় আন্দোলনে যেতো আমাদের না বলে। আমার বাসা টঙ্গীতে। পরীক্ষার হল থেকে আন্দোলনে যেতো। আমি চা বিক্রি করি সেখানে ব্যস্ত থাকতাম। যখন আমি এটা বুঝতে পারি নাফিসা আন্দোলনে যাচ্ছে তখন তার সেফটির জন্য সাভারে তার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। তখনো ওদের মা দেশের বাইরে থাকতো। সেখানে তার মামার বাসায় দু-তিনদিন ছিল। এরপর সে সেখান থেকে আবার আন্দোলনে যোগ দেয়। মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথাবার্তা হতো। আন্দোলনে কি হতো সবকিছু বলতো। তখন আমি তাকে বলতাম তুমি সেইফ থাকো। কারণ আমি তো তার কাছে ছিলাম না; ওর যদি কিছু হয়ে যায়। ঘটনাটি ছিল ৫ই আগস্টে। তার আগের দিন ৪ঠা আগস্ট ওর সঙ্গে আমার কথা হয়। ৫ তারিখে যখন ওর নানীর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় তখনো কাউকে বলে যাইনি। যদি কেউ জানতে পারতো তাহলে তো তাকে আটকাতো। আমার কাছে ওর সবসময় আবদার ছিল আমি যেন কষ্ট হলেও তাকে ভালোভাবে পড়াশোনা করাই। ও খুব মেধাবী ছিল। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হবে বিদেশ যাবে লেখাপড়া করতে। খাবার বা কোনো পোশাকের প্রতি তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। আমার মেয়েটা যে নেই সেই শূন্যতা পুরোপুরি অনুভব করি। তিনি বলেন, ২০২২ সাল থেকে ওর মা বিদেশ থাকে। নাফিসা মারা যাওয়ার পর দেশে এসেছিল; আবার চলে গেছে কুয়েতে। আমার আরেকটি মেয়ে সাভার রয়েছে বর্তমানে। আমাকে তো কাজ করতে হয়; আমি তো ঠিকমতো ওর যত্ন নিতে পারবো না। একজন শহীদের বাবা হিসেবে আমি দেখতে চাই দেশ যেন সবসময় শান্তিময় থাকে। মানুষের হানাহানি, মানুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য না থাকে। মানুষ যেন শান্তিতে থাকতে পারে।