
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত শেষ করে কবে নাগাদ আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে, তা এখনও জানেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। মাসখানেক আগে নতুন নিয়োগ পাওয়া তদন্ত কর্মকর্তাও এ বিষয়ে এখনও বিস্তারিত অবহিত নন। এছাড়া রিজার্ভ চুরির মামলা খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। তিন মাসের মধ্যে কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেই প্রতিবেদন দিতে পারেনি। নতুন করে ওই কমিটিকে আরও তিন মাসের সময় দিয়ে গত ৮ জুলাই আদেশ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ দেওয়ার কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। যা ফিলিপাইনের ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) হয়ে চলে যায় সেখানকার বিভিন্ন জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে চুরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একদিন পর চুরির তথ্য জানতে পারে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় রিজার্ভ চুরি হওয়ার ৩৩তম দিনে। ঘটনার ৩৯ দিন পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে সেই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে।
রিজার্ভ চুরির বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তৎকালীন সরকার। ফরাসউদ্দিন কমিটি দেড় মাসের মাথায় ৩০ মে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন এখনও অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। এছাড়া মামলার অভিযোগপত্রও অদ্যাবধি দিতে পারেনি সিআইডি। যে কারণে দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে কারা ছিল।
সিআইডির সূত্র জানায়, চুরির ঘটনার প্রথম বছরেই ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরত আনা গেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা ওই দেশ দুটি স্বেচ্ছায় দিয়েছিল। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ডলারের বিষয়ে ফিলিপাইনের আদালতে ১২টি মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব মামলার অগ্রগতি খুব একটা না থাকলেও বাংলাদেশের সিআইডি বলছে, তাদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেয়। চলতি বছরের ১১ মার্চ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে প্রধান করে ছয় সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে গঠন অন্তর্বর্তী সরকার। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্তকাজের অগ্রগতি এবং এ সংক্রান্ত সরকারি অন্যান্য পদক্ষেপের পর্যালোচনা, ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার কথা বলা হয় কমিটিকে। এ জন্য প্রথমে কমিটিকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় এখন আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আদেশে বলা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটি গঠনের এক মাস পর ১৩ এপ্রিল (২০২৫) কমিটির প্রধান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন—‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে দুই বিলিয়ন ডলার চুরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দুই বিলিয়ন ডলার চুরির পরিকল্পনা করা হলেও হ্যাকাররা শেষ পর্যন্ত হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ৮৮ মিলিয়ন ডলার চুরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করারও পরিকল্পনা করা হয়। আর এ ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বাঁচানোর নির্দেশনা দিয়েছিল বিগত সরকার। সে সময় প্রাথমিক রিপোর্টে যাদের নাম এসেছিল তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—সেটা জানতে চাওয়া হবে। যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রিজার্ভ চুরির পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা হলেন—জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর; বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক আলী আশফাক এবং রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল হুদা।
তদন্ত কবে শেষ হবে এবং অভিযোগপত্র কবে নাগাদ দেওয়া হবে জানতে চাইলে মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরহাদ কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক-দেড় মাস আগে তিনি মামলাটির তদন্তের দায়িত্বভার পেয়েছেন। প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তিনি পড়া শুরু করেছেন। এরপর পর্যালোচনা হবে। তারপর অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি আসবে। তবে কবে নাগাদ এটা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলতে পারেননি।