
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি এখন হুমকির মুখে। মাছের দুষ্প্রাপ্য, কাঁচা মাছের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদকদের আর্থিক দুর্দশার কারণে এ শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। গত এক দশকে শুঁটকির প্রজাতি কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ এবং একই হারে কমেছে শুঁটকিপল্লির সংখ্যাও। এর ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সস্তা শুঁটকি আমদানি, যা স্থানীয় বাজারকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র উৎপাদকরা পুঁজি হারিয়ে পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকিশিল্প তার জৌলুস হারাতে বসেছে।
শুঁটকি উৎপাদনের হ্রাসের কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীভাস চন্দ্র চন্দ বলেন, বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে শুঁটকি আমদানি বেড়েছে। একই সঙ্গে শুঁটকির চেয়ে কাঁচা মাছ বিক্রি লাভজনক মনে করায় জেলেরা শুঁটকি উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এ ছাড়া জেলেরা পুঁজির জন্য মহাজনকে একপ্রকার বাধ্য হয়ে কাঁচা মাছ দিতে হচ্ছে। এসব কারণেই শুঁটকির উৎপাদন দিনদিন কমছে। গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমছে শুঁটকি উৎপাদন। শুঁটকিশিল্পের বর্তমান সংকট উঠে এসেছে উৎপাদন হ্রাসের পরিসংখ্যানে। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুঁটকির মোট উৎপাদন ১ হাজার ৪২০ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৭০ টনে।
গত মৌসুমে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৫ শ টনের ঘরে। প্রধান শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতেও মিলেছে উৎপাদন হ্রাসের ভয়ংকর চিত্র। এক সময় চট্টগ্রাম শহরের শুঁটকিপল্লিগুলোতে উৎপাদন হতো ২৭০ টন শুঁটকি। বর্তমানে তা কমে হয়েছে ১৭০ টন। আনোয়ারা উপজেলায় এক সময় ৪৩০ টন শুঁটকি উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা নেমে হয়েছে ১৯০ টনে। একইভাবে বাঁশখালী উপজেলায় ৬১০ টন কমে হয়েছে ৪৪০ টন এবং কর্ণফুলী উপজেলার শুঁটকি ১১০ টন কমে হয়েছে ৭০ টনে।
জানা যায়, উন্নতমানের শুঁটকির জন্য এক সময় দেশ-বিদেশে খ্যাত ছিল চট্টগ্রামের শুঁটকি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গভীর সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শুঁটকিশিল্প। মাছের দুষ্প্রাপ্য, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদকদের আর্থিক দুর্দশার মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জের কারণে এ শিল্প দ্রুত পথোন্মুখ। অথচ এক সময় ৪০ থেকে ৪৫ প্রজাতির মাছ থেকে শুঁটকি বানানো হলেও এখন তা কমছে দুই-তৃতীয়াংশ। বর্তমানে শুঁটকিপল্লিগুলোতে ফাইশ্যা, ছুরি, লইট্টা, মধুভাইস্যা, পোয়া মাছ, রূপচাঁদা, পোপা, বিভিন্ন প্রজাতির হাঙর মাছ, পাতা মাছসহ ১২ থেকে ১৫ প্রজাতির মাছ থেকে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। শুঁটকির প্রজাতির সঙ্গে সঙ্গে গত এক দশকে কমেছে শুঁটকির পল্লিও। এক দশক আগেও চট্টগ্রামের নোমান কলেজ এলাকায় ১৪০টির মতো শুঁটকিপল্লি ছিল। বর্তমানে তা কমে হয়েছে মাত্র ৩৫টি। এ ছাড়া কর্ণফুলীর দক্ষিণে ইছানগর, জুলধার আশপাশে ৬০ থেকে ৭০টির মতো শুঁটকিপল্লি ছিল। সেটা এখন ৩২টিতে নেমে এসেছে। উৎপাদন ও শুঁটকিপল্লি হ্রাস পেলেও বেড়েছে চাহিদা। যার প্রভাব পড়েছে আসাদগঞ্জের শুঁটকির পাইকার বাজারে।
তিন বছর আগে চিংড়ি শুঁটকি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বর্তমানে তা রকম ভেদে বিক্রি হচ্ছে কেজি ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা। একইভাবে ৫০০ টাকার ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে কেজি ১৬০০ থেকে ২৫০০ টাকায়। ৪০০ টাকার লইট্টা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১১৫০ থেকে ১৪০০ টাকা। অভিন্নভাবে দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে অন্যান্য শুঁটকির দাম। শুঁটকিশিল্পের এমন সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়া ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে শুঁটকি আমদানি। ভারত এবং মিয়ানমার থেকে সস্তা আমদানি করা শুঁটকির আগমন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে, যা স্থানীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ী এবং গুদাম মালিকদের জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে। আসাদগঞ্জ শুঁটকিপল্লির ব্যবসায়ী নুর হোসেনের দাবি, চট্টগ্রামের শুঁটকির মান এখনো অনেক উন্নত। আমদানি করা পণ্যের তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্য স্থানীয় বিক্রি এবং স্থানীয় পণ্যের বাজার সার্বিক অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পূর্বে চট্টগ্রাম দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে শুঁটকির প্রধান সরবরাহকারী ছিল। এখন মিয়ানমার ও ভারত থেকে শুঁটকি আসছে।
এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগে, ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রাণশক্তি ক্ষুদ্র উৎপাদকরা তীব্র আর্থিক সংকটে ভুগছেন। মাছের দাম বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে পরিবহন ও শ্রম ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি উৎপাদনকে ক্রমেই অলাভজনক করে তুলছে। অনেক উৎপাদককে বাধ্য হয়ে বাকিতে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমনকি বছরের পর বছর ধরে পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যার ফলে মূলধন ক্ষয় হচ্ছে এবং অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র শুঁটকি উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৮০ থেকে কমে মাত্র ৭৫-এ এসেছে।