Image description
সংসদের উচ্চকক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে সুরাহা হয়নি, পিআর পদ্ধতিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতেই বাড়ছে অনৈক্য

রাষ্ট্র  সংস্কারের মৌলিক কয়েকটি ইস্যুতে আটকে গেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল। দফায় দফায় এবং দিনের পর দিন ওই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে অন্যতম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষ। উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল একমত হলেও এর নাম, গঠন, মেয়াদ ও দায়িত্ব নিয়ে রয়েছে নানান মত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কাঠামোতেও একমত হতে পারেনি দলগুলো।

বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। একই পথে হেঁটেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে উচ্চকক্ষের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ওপর ভার ছেড়ে দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন আগামী বুধবার বিষয়টি নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী বুধবার উচ্চকক্ষ সম্পর্কে কমিশনের চূড়ান্ত মতামত রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হবে। যারা মানবে তারা মানবে, যারা মানবে না তারা মানবে না। এমনকি কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।

এর আগে গতকাল সকালে সংলাপের শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে উচ্চকক্ষের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে। উচ্চকক্ষের নাম বিএনপি ও সংস্কার কমিশন ‘সিনেট’ হিসেবে সুপারিশ করেছে। জামায়াত কোনো নাম উল্লেখ করেনি। আর এনসিপি উচ্চকক্ষের নাম ‘জাতীয় পরিষদ’ প্রস্তাব করেছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষের আসন নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) চালুর বিষয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে একমত হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়েছে বিএনপি। বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের বিষয়ে বিএনপি রাজি হলেও উচ্চকক্ষের আসন নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে রাজি নয়। তিনি বলেন, বিএনপি মনে কনে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন হওয়া উচিত নারী সংরক্ষিত আসনের মতো আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে। তিনি বলেন, ‘যাঁরা উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেন তাঁদের নির্বাচনপদ্ধতির বিষয়ে আমরা চাই, সংবিধান অনুসারে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন যেভাবে নির্বাচিত হয় আসনের ভিত্তিতে, সে অনুসারে নির্বাচিত হবে।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে আমাদের দলসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল একমত। তবে এটির ঘটনপ্রক্রিয়া ও পাওয়ার অ্যান্ড ফাংশন কী হবে, সে বিষয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে।’

তিনি বলেন, বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে ইতোমধ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিএনপির মূল লক্ষ্য সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক একটি উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে বিএনপির। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে অনেক দল প্রশ্ন তুলেছে বলেও জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো আর্থিক অবস্থায় থাকা একটি দেশে আরেকটি ব্যয়বহুল নিম্নকক্ষের ‘রেপ্লিকা পার্লামেন্ট’ তৈরি করা কতটা দরকার, তা ভাবা উচিত।

অন্যদিকে সংসদের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ ও সংরক্ষিত নারী আসন-সবক্ষেত্রেই পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ আরও কিছু দল।

বিষয়টা নিয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর পদ্ধতি চায় তাঁর দল। ‘দুই-তৃতীয়াংশ দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে একমত হয়। জামায়াতও এর পক্ষে।

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শুধু উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতিতে চাই। এ নিয়ে কোনো ধরনের আপস নেই। কমিশনকে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছি।’

সব মিলিয়ে উচ্চকক্ষে পিআর নিয়ে বড় ধরনের বিভক্তি তৈরি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের আলোচনায় উচ্চকক্ষের বিষয়ে আগেও বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও জোট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে সমর্থন জানিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছ থেকে একই মতামত পাওয়া যায়। আলোচনায় দুভাবে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, কেউ কেউ বলছেন, ভোটের সংখ্যানুপাতে যেন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে নিম্নকক্ষে পাওয়া আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও আছে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি।

এদিকে আলোচনার মাঝে ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে নতুন প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। নতুন এই প্রস্তাবে বলা হয়, উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা হতে পারে ৭৬টি এবং এসব আসনের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। এর আগের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের। উচ্চকক্ষের নতুন প্রস্তাবের বিষয়ে কমিশন জানিয়েছে, প্রতিটি জেলা ও প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকা উচ্চকক্ষের একেকটি একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকা থেকে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে একজন করে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এতে আরও বলা হয়, বর্তমানে দেশে ৬৪টি প্রশাসনিক জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে ফলে উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা হবে ৭৬টি। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষের নাম প্রস্তাব করা হয় ‘সিনেট’।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ করে যে বাংলাদেশে নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষের (সিনেট) সমন্বয়ে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভা থাকবে। উচ্চকক্ষ আইনি যাচাইবাছাইয়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাহী ক্ষমতার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা আইনসভা হলো এমন একটি আইনসভা যা দুটি পৃথক কক্ষ নিয়ে গঠিত। যেখানে একটি কক্ষকে ‘উচ্চকক্ষ’; অন্যটিকে ‘নিম্নকক্ষ’ বলা হয়। এ ধরনের আইনসভায় আইন প্রণয়নে সমান ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান এক কক্ষের জাতীয় সংসদে মোট আসন ৩৫০টি। যার মধ্যে ৩০০টি আসনে সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। আর ৫০টি আসন থাকে নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সাধারণ নির্বাচনে পাওয়া আসনের অনুপাতে এসব আসন বণ্টন করা হয়। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষে থাকবে ৪০০টি আসন। আর উচ্চকক্ষে থাকবে ১০৫টি আসন। নিম্নকক্ষের ৪০০টি আসনে প্রচলিত ব্যবস্থায় অর্থাৎ সরাসরি জনগেণর ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের ১০০টি আসনে নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে সারা দেশে মোট যত ভোট পাবে; সেই অনুপাতে তারা উচ্চকক্ষে আসন পাবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কাঠামোতে একমত হতে পারেনি দলগুলো : তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কাঠামোর নানা ইস্যুতে দীর্ঘ আলোচনা হলেও একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে কমিশন প্রস্তাবিত একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদপ্রধান ও দলীয় প্রধান একজন হতে পারবে না, এমন প্রস্তাবের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সমর্থন জানালেও সরাসরি বিরোধিতা করেছে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদপ্রধান একজন হতে পারেন, এমন প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়ে দলগুলোর প্রতিনিধিরা ভিন্ন ভিন্ন মত তুলে ধরেছেন। গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৫তম দিনে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আলোচনার প্রথমার্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় পুনরায় একটি সংশোধিত সমন্বিত প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটিতে বিস্তারিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং এ প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। এ খসড়া প্রস্তাবটির ওপর ভাষাগত ও খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে আগামী মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং বাকি দিনগুলোর আলোচনায়ও আরও কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকলে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। কমিশনের প্রস্তাবিত খসড়া অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি মিলে পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠিত হবে। সরকার ও বিরোধী দল তিনজন করে এবং তৃতীয় দল দুজনের নাম প্রস্তাব করবে। এই আটজনের মধ্য থেকে র‌্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত করা হবে। প্রস্তাবটি আলোচনাকালে বাছাই কমিটি ৫ থেকে ৭ সদস্যের করার প্রস্তাব এসেছে। একই সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের বাইরেও অন্যান্য দলের পক্ষ থেকেও প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য নাম প্রস্তাব করার বিধান রাখার পরামর্শ এসেছে।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান গঠনে ভোট নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রক্রিয়াকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান গঠনে ৫ বা ৭ সদস্যের কমিটির যে দুটি প্রস্তাব এসেছে, আমরা কোনোটিরই বিরোধিতা করছি না। আমাদের মূল কথা একটাই- কমিটির সদস্য মনোনয়ন হোক সর্বসম্মতভাবে, কোনোরকম ভোটাভুটির মাধ্যমে নয়। তিনি বলেন, র‌্যাংকড চয়েস ভোটিং বা ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলে তা নেতিবাচক রাজনীতির পথ খুলে দেবে, ফলে অশুভ দর-কষাকষি, হর্স ট্রেডিং হতে পারে এটা আমরা অতীতে দেখেছি। এ ক্ষেত্রে যদি কমিটিতে রাজনৈতিক ঐকমত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব না হয়, তবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, পাঁচ সদস্যের কমিটি হলে সরকার ও বিরোধী দল থেকে দুজন করে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল থেকে একজন সদস্য রাখা যেতে পারে। সাত সদস্যের কমিটির ক্ষেত্রেও সরকার ও বিরোধীপক্ষ থেকে তিনজন করে এবং তৃতীয় দলের একজন সদস্য রাখা যেতে পারে। তবে কমিটির সদস্য সংখ্যা যাই হোক, তা হতে হবে সর্বসম্মতিক্রমে। কাউকে বাদ দিয়ে, ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেন না হয়।

অপর প্রস্তাবের বিষয়ে ডা. তাহের বলেন, আমরা মনে করি, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারেন, তবে একই সঙ্গে দলের প্রধান থাকা যাবে না। এতে রাজনৈতিক কাঠামোয় ভারসাম্য ফিরে আসবে, নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, আমরা বলছি না, এসব প্রস্তাব স্থায়ীভাবে থাকুক। কোরআনের আয়াত নয় যে, চিরন্তন থাকবে। এখন যে সংকট চলছে, তার জন্য কিছু অস্থায়ী নিয়ম দরকার। রাজনীতিতে বিশ্বাস ফিরলে ভবিষ্যতে এসব শিথিল করা যেতে পারে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, আমরা প্রায় দুই মাস আগেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি রূপরেখা জমা দিয়েছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বাছাইয়ের জন্য একটি ৫ থেকে ৭ সদস্য বা ১১ সদস্যের কমিটি গঠিত হবে। এ কমিটি সরকারি দল, বিরোধী দল এবং সংসদে তৃতীয় অবস্থানে থাকা দলের কাছ থেকে নাম সংগ্রহ করবে। এরপর অন্যান্য দলের দেওয়া প্রস্তাব মিলিয়ে একটি সম্মিলিত খসড়া প্রণয়ন করেছে কমিশন। আমরা বিচার বিভাগকে এ প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বাইরে রাখার পক্ষে। তবে কমিটি ৫ বা ৭ জনের হলে আপত্তি নেই।

একজনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে থাকার বিরোধিতা করে এনসিপি নেতা বলেন, একই ব্যক্তি যখন দলের প্রধান, সরকারের প্রধান এবং সংসদের নেতা হন, তখন দলে আর কাউকে নেতৃত্বের সুযোগ দেওয়া হয় না। এমনকি অনেক নেতা-কর্মী এমপি হওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারেন না, কারণ দলের মনোনয়নও দেন সেই এক ব্যক্তি। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে বিকল্প নেতৃত্ব গঠিত হবে না। আমাদের প্রস্তাব, প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা এ তিনটি পদে আলাদা ব্যক্তি থাকা উচিত। যদি কেউ প্রধানমন্ত্রী হন, তবে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে হবে। তিনি যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে প্রধানমন্ত্রীরা পরিবর্তন হয় নিয়মিত, বিকল্প তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার বিকল্প নেই’, ‘খালেদা জিয়ার বিকল্প নেই’, কিংবা এখন বলা হয়, ‘তারেক রহমান ছাড়া চলবে না’। এ সংস্কৃতি ভাঙতেই আমাদের এ প্রস্তাব।

ন্যূনতম একটা ভোটের ফ্যাশন তৈরি করা দরকার বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, দশমিক ৫ কিংবা এক শতাংশও যেসব দল ভোট পায় তাদেরও আগামীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাবে মতামত দেওয়ার জায়গা থাকা দরকার। অনেকের প্রস্তাব করেছে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাছাই কমিটি করতে। আমরা বলেছি, বাছাই কমিটি যদি তিন দলের মধ্যেই অর্থাৎ সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল এবং বৃহত্তম তৃতীয় দলের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সব দলই যাতে নাম প্রস্তাব করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সদস্য নয় কিংবা সংসদ সদস্য যারা আছেন তারাই নয়। দেখা যায়, একটা দল অনেক ভোট পেতে পারে কিন্তু তাদের কোনো সংসদ সদস্য নেই। এমন দশমিক ৫ অথবা এক শতাংশ ভোট পায় তাদের মতামত দেওয়ার জায়গা রাখতে হবে।