
দাদন। উপকূলীয় জেলেদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক মহাজনী ব্যবসা। হাতে যখন কাজ থাকে না, তখন মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে জীবনধারণ করেন জেলেরা। মৌসুমে তারা সাগরে মাছ ধরেন। দাদনের বিনিময়ে ওই মাছের বড় অংশ দিয়ে দিতে হয় মহাজনদের। এভাবেই দাদন ব্যবসায়ীর কবলে পড়ে জীবনচক্র আবর্তিত হয় জেলেদের। এমন দাদন ব্যবসা আছে আরও নানা স্থানে, নানা পেশা ঘিরে। কিন্তু ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য অপরাধে এই দাদন দেয়ার মতো তথ্য মিলেছে খোদ রাজধানীতে।
উপকূলীয় জেলেদের মতো ছিনতাইকারীরাও এখন ‘দাদন’ পদ্ধতিতে ছিতাইয়ের সরঞ্জাম ও টাকা যোগাড় করছে। মোটরসাইকেল, চাপাতি, সামুরাইসহ ধারালো অস্ত্র আগাম টাকা ছাড়াই ভাড়া পায় ছিনতাইকারীরা। এমনকি, ছিনতাই করতে গিয়ে কেউ যদি ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রেও ছাড়িয়ে আনার জন্য দাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। দ্রুত জামিনের জন্য আগাম টাকাও দাদন হিসেবে পাচ্ছে তারা। ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রি করতে হয় ‘দাদন’ ব্যবসায়ীদের কাছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন ছিনতাইকারী এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
গত ১১ই জুলাই সকাল ৬টার দিকে শিমিয়ন ত্রিপুরা (৩০) নামে এক যুবক শ্যামলী থেকে ধামরাইয়ে তার কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথে শ্যামলী মেরিগোল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কাছে পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেলে এসে ৩ ছিনতাইকারী তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। চাপাতি ও হাসুয়া দিয়ে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে নগদ টাকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক কার্ড ও অফিস আইডি কার্ডসহ তার ব্যাকপ্যাক ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়াও সে সময় শিমিয়নের পকেট থেকে একটি মোবাইল ফোন, তার পায়ের জুতা ও গায়ের টি-শার্টও খুলে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। অস্ত্রের মুখে গায়ের জামা ও জুতা ছিনতাইয়ের ওই সিসিটিভি ফুটেজ মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী শিমিয়ন ত্রিপুরা ঘটনার পরদিন শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই ঘটনার তদন্তে নেমে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রযুক্তির সহায়তায় গত বুধবার ভোরে ঢাকা, কেরানীগঞ্জ ও ভোলার চরফ্যাশন থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ও চাপাতিসহ আল আমিন (২৮), আসলাম শিকদার (২৯) ও কবির (২২) নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা তেজগাঁও (ডিবি) বিভাগের সদস্যরা। এরমধ্যে আল আমিন ও আসলাম ছিনতাইয়ের কাজে সরাসরি জড়িত থাকলেও কবিরের পরিচয় ভিন্ন। তিনি মাঠপর্যায়ে ছিনতাই না করলেও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র, মোটরসাইকেলসহ যাবতীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আল আমিন ও আসলাম জানিয়েছে, তারা শুধু শ্যামলী নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। আর তাদের এই ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল-অস্ত্র তারা ভাড়া নেন কবির ও জহিরের কাছ থেকে। কবির ও জহির আপন দুই ভাই। এসব ছিনতাই চক্রের তারাই মূলহোতা। তারা (জহির ও কবির) নিজেরা কখনোই ছিনতাই করে না। তবে ঢাকার একাধিক ছিনতাই চক্র দেখভাল করেন। এ চক্রের সদস্যদের দিয়ে প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় তারা চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে এসব চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না। ছিনতাই শেষে মালামাল বিক্রির পর ভাড়ার টাকা মেটাতে হয়। এই ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রিতেও নেই টেনশন। ছিনতাইয়ের মালামাল জহির-কবির সিন্ডিকেটের কাছেই বিক্রি করতে হয়। আর এর সুবিধা হচ্ছে, যদি কেউ ছিনতাই করতে গিয়ে আটকও হয়, তখন দাদন হিসেবে সুদে অগ্রিম টাকা ধার দেয় চক্রটি। যাতে সহজেই জামিনে বের হয়ে এসে আবারো আগের মতো কার্যক্রম চালাতে পারে ছিনতাইকারীরা।
আটককৃতরা জানিয়েছে, এই দুই ভাইয়ের মধ্যে কবিরের কাজ ছিনতাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা ও নিয়ন্ত্রণ করা। অগ্রিম কোনো টাকা লাগলে সেটা কবির বণ্টন করে। পরে ছিনতাই করে ধারের টাকা পরিশোধ করে মাঠপর্যায়ের ছিনতাইকারীরা। আর ছিনতাইয়ের স্পট, কয়টি চাপাতি ও মোটরসাইকেল লাগবে তা জহির নির্ধারণ করে। বিনিময়ে ছিনতাইকারীরা যে ছিনতাই করবে, সেগুলোর মালামাল জহিরের কাছে বিক্রি করা বাধ্যতামূলক। অন্য কোথাও ছিনতাইয়ের মালামাল বিক্রি করতে পারে না চক্রের সদস্যরা। সেখান থেকেই ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, এমন দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী চক্র এই প্রথম চিহ্নিত হয়েছে। যারা ছিনতাইয়ের জন্য চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দেয়। তিনি বলেন, এই ছিনতাইয়ের কাজে সরাসরি জড়িত থাকায় আল আমিন ও আসলাম নামে দু’জনকে আটক করা হয়েছে। ছিনতাইয়ের কাজে জড়িত পারভেজ নামে আরও একজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে ১৭-১৮টি করে মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অস্ত্র ও গাড়ি ভাড়া দেয়া চক্রের কবিরকে মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হলেও চক্রের আরেক হোতা জহির এখনো অধরা। তাদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, এই চক্রের সদস্যরা এরআগেও গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনে বের হয়ে আবারো তারা একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ রাকিব খান বলেন, শ্যামলীতে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি শ্যামলীর দুই নম্বর সড়কের মেরিগোল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ওই সিসি ক্যামেরার ফুটেজটি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনজনের মুখে মাস্ক ও মাথায় হেলমেট থাকায় তাদের শনাক্তে বেগ পেতে হয়েছে। এজন্য মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। এরপর সিসি ক্যামেরায় মোটরসাইকেলটি দেখে শনাক্ত করা হয় ছিনতাইকারীদের। তিনি বলেন, এই ঘটনায় আমাদের সামনে চাঞ্চল্যকর তথ্য ওঠে এসেছে। এরা এমন একটি চক্র, যারা অগ্রিম চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছিনতাই করায়। জাকির-রুবেলসহ রাজধানীতে এ ধরনের তিনটি চক্র কাজ করছে। তারা ছাড়াও চক্রগুলোতে অনেক সদস্য রয়েছে। তাদের রহস্য উন্মোচন হয়েছে। চক্রের সকল সদস্যকে আইনের আওতায় আনতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনাকীর্ণ যেসব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে ছিনতাইকারীদের প্রতিহত করা সম্ভব। তাই ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদেরও এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, আমরা অনেক ছিনতাইকারী আটক করেছি। কিন্তু ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল-চাপাতি ভাড়া দেয়া আগে দেখেনি। এই অভিনব চক্রের সন্ধান এই প্রথম পাওয়া গেল। আমরা ইতিমধ্যে এই চক্রের ৩ জনকে আটক করেছি। তাদের মধ্যে মূলহোতা দুই ভাইয়ের একজন রয়েছে। চক্রটির অন্য সদস্যদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে। আশাকরি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো। অভিনব এই চক্রের সকল সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে পারলে ঢাকা শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে বলেও আশা করেন পুলিশের এই মুখপাত্র।