কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হন।
তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ও নরসিংদীতে দু’জন করে এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন শিক্ষার্থী এদিন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এর আগে ১৬ জুলাই আন্দোলনে সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৩৭ জনে পৌঁছায়।
১৮ জুলাই সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির দিনে রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবন এবং মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, ডাটা সেন্টার ও সেতুভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া মিরপুর, মহাখালী, বাড্ডাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় পুলিশ বক্সে আগুন ও ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা। উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
ওই দিন রাজধানীর রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান রাজধানীর ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত হন।
ফারহানকে নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন তার ছোট বোট সায়মা ফারিন। তাতে তিনি ‘শুধু ভাইয়াকে হারাইনি, জাতি একটা রত্ন হারিয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন।
ফেসুবকে সায়মা লেখেন, আমার ভাইয়া… শহীদ ফারহান ফাইয়াজ… এখন এই নামেই পরিচিত। ভাইয়ার পুরো নাম মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ফাইয়াজ। গত ১৮ জুলাই, ২০২৪ তারিখে ভাইয়া ‘শহীদ ফারহান ফাইয়াজ সড়ক’ (পুরনো ধানমন্ডি ২৭) এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সৈরাচারী বাহিনীর গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়। আর সেসময়েই তার জীবনের আলো নিভে যায়।
আমার ভাইয়া ছিল আমার থেকে ১ বছর ১০ মাসের বড়। ওর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। এখনো অবশ্য ১৭ই ওর বয়স, কারণ ও তো ১৭ তেই আটকে থাকবে।
ভাইয়া ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। আমরা ছিলাম এক ভাই, এক বোন… আর এখন? আমি তো একা, খালি হাহাকার জীবনে। আমার একমাত্র ফুলের মতো জলজেন্ত ভাইকে স্বৈরাচারী বাহিনী টার্গেট করে ঠিক বুক বরাবর গুলি করে মেরেছে!!
আমার ভাই ছোট থেকেই ছিল খুব মেধাবি। তার ছোট একটা উদাহরণ আপনাদেরকে দেই, ভাইয়াকে যখন ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয় তখন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে ভাইয়া ভর্তি পরীক্ষায় দশম স্থানের অধিকারী হয়। শুধু এটা না ওর স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কিংবা যত শিক্ষক এখন পর্যন্ত ভাইয়াকে পড়িয়েছে প্রত্যেকের কাছেই ওর বেশ সুনাম রয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষকই বলত, ভাইয়াকে কোনো পড়া একবার দেখিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার তা আর দেখানো লাগত না। আমার ভাইয়া কখনো বই নিয়ে সারাদিন বসে থাকত না। তবে যে সময়ই পড়ত খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ত আর খুব অল্পতেই কোনো পড়া ক্যাপচার করে ফেলতে পারত ব্রেইনে।
মেধা যেমন ছিল ঠিক তেমনি দেখতে শুনতেও ছিল খুব নম্র, ভদ্র, উদার, মানবিক। ভাইয়া যেখানেই যেত সবাই তাকে পছন্দ করত। করবেই না বা কেন? আমার যেই ভাই কখনো করো সাথে ঝগড়া তো দূরে থাক গলা উঁচু করেও কোনো দিন কথা বলেছে- এরকম মন্তব্য পাওয়া বড়ই মুশকিল।
নিজের ভাই বলে আমি বলছি না, আমার ভাই না আসলে একটা ফেরেশতা ছিল বটে। কেননা ওর চেহারাতে একটা নূর দেখতে পেতাম আমরা সবসময়, আর ও তো ছিলই নিষ্পাপ একটা বাচ্চা! ভাইয়ার বন্ধু-বান্ধবরা ভাইয়ার সৌন্দর্যের জন্য তাকে দুষ্টমি করে ধলা বলেই ডাকত।
ভাইয়া ছোট থেকেই তার স্কুলের সাইন্স ফেস্ট-এর সাথে সংযুক্ত ছিল। সে প্রত্যেক বছর ফেস্টে পার্টিসিপেট করত আর অনেক ক্রিয়েটিভ জিনিস বানাত। কখনো কখনো কোনো কিছুর হেল্প ইউটিউব থেকে নিত আর সেভাবেই বহু আকর্ষণীয় জিনিস বানাত। আর গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ভাইয়া নিজে সাইন্স ফেস্টের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিল ফেস্ট টাকে পরিপূর্ণভাবে ম্যানেজ করার জন্য। ও ছিল সাইন্স ক্লাবের একটিভ মেম্বার, ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আলাপও চলছিল। বড় হয়ে হতে চাইত সায়েন্টিস্ট কিংবা গবেষক, তো কখনো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার।
যখন ভাইয়া কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, তখন থেকেই সে ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স অর্থাৎ যেই বই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ে সেই বই সে কলেজে থাকতেই পড়ত। এরকম বহু একাডেমিক বই সে কলেজে থাকতেই পড়ত। এছাড়াও সে বিভিন্ন রকমের বই পড়ত।
ভাইয়ার ইচ্ছা ছিল এইচএসসি এক্সাম শেষ করে হায়ার এডুকেশন এর জন্য ইউকে চলে যাওয়া। যদিও বাবা প্রথমে রাজি হয়নি, পরে ভাইয়া যখন বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে যে সে এইচএসসির পর বুয়েটে এক্সাম (এর জন্যই ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স বইটা পড়ত) দিয়ে চান্স পেয়ে দেখাবে তবে তাও সে ইউকেতেই পড়তে যাবে এবং পড়া শেষ করে আবার দেশে ফিরে এসে দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে তখন বাবা রাজি হয়। আর তারপর সেরকম প্রস্তুতুতিই নেয়া হচ্ছিল। কিন্তু তারপর তো…।
এবার ভাইয়ার উদারতার গল্প বলা যাক। গত বছর যখন ভাইয়া সাইন্স ফেস্টে ভলান্টিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তখন ও নিজে না খেয়ে ওর নিজের খাবারের প্যাকেটটাই এক জুনিয়র ভাইকে দিয়ে দেয়। এমনকি কোভিড ১৯ এর সময়েও রাস্তার বহু অসহায় মানুষকে সে খাবার বিতরণ করে। এটা তো জাস্ট উদাহরণ দিলাম, এরকম বহু বৈশিষ্ট্য ভাইয়ার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। বলা যায় ভাইয়ার আদর্শে মানবতা ও উদারতার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিল। যে সব সময় নিজের কথা না ভেবে পরের কথা ভাবতো আর ছিলই তো পরোপকারী। নিজের সর্বস্ব দিয়ে পরকে ভালো রাখতে চেষ্টা করত।
তারপর এলো ভাইয়ার জীবনে সেই অভিশপ্ত ১৮ জুলাই!! যেদিন ভাইয়া সকাল ১০.৩০টার দিকে একটা কল পেয়ে ঘুম থেকে উঠে যায়। আর তারপর তাড়াহুড়া করে গোসল করে রেডি হয়ে কলেজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আম্মুকে সালাম দিয়ে ১১.৩০টার দিকে বের হয়ে যায়। আম্মু অনেকবার বারণ করেছিল, কিন্তু শুনেনি ও। ভাইয়া যখন একটা কিছু বলত তখন সেটা করেই ছাড়ত।
তারপর তো আম্মু আর আমি অনেক টেনশনে পরে যাই চারিদিক থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাইয়াকে আম্মু কল করে ১টার একটু পর, তারপর ও কল রিসিভ করে বলে ও ধানমন্ডির রাপা প্লাজার ওখানে লুকিয়ে আছে আর আম্মু তখন বলে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে। তারপরেই কলটা কেটে যায়। আবারও আম্মু অনেকবার কল করে কিন্তু তারপর আর কল ধরে না ভাইয়া।
তারপর ভাইয়া ধানমন্ডি ২৭ জেনেটিক প্লাজার সামনে ১.৪৫টা থেকে ২.১৫টা তার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়। ২.৩০টার দিকে ভাইয়ার ফ্রেন্ড ওয়াসিফ ভাইয়া বাবাকে কল করে জানায়, আর বাবা দ্রুত সিটি হসপিটালে ছুটে যায়।
তারপর আর তো পেল না বাবা ভাইয়াকে।
ভাইয়া শহীদ হওয়ার পর পরই আমার আন্টি নাজিয়া খান ফেসবুকে একটি পোস্ট করে। যেখানে লিখা ছিল, This is my Farhan Faiyaaz. He is dead now. I want justice.
এই পোস্ট ১৮ জুলাই যখন বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবার মনে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। কেউ আর নিজেকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারে না। মা, বোন, ভাই, শিক্ষক, পেশাজীবীরা রাজপথে নেমে পরে বিচারের জন্য। ভাইয়ার মৃত্যুর পর আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান হিসেবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো ভাইয়ার ঘটনার পরই জানতে পারে বাংলাদেশের এই করুণ পরিস্থিতি সম্পর্কে। তারপর তারা যখন খুনি হাসিনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখনি খুনি হাসিনা ১০ দিনের জন্য ইন্টারনেটে অফ করে দেয় আর এরই মধ্যে সে গণহত্যা চালায়, লাশ গুম করে পুড়িয়েও ফেলে।
১৮ জুলাই যখন আমরা ভাইয়াকে দাফন করার জন্য আমাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল, তখনও আমাদের গাড়িতে হামলা করা হয় এবং কাঁচ ভেঙে দেয়। আমার খালা আমার পাশেই বসেছিলেন, আর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গাড়ি লক করা না থাকায় গেট খুলে আমার খালাকে গাড়ি থেকে নামানো শুরু করে। ওরা যদি জানত আমার ভাই একজন শহীদ, তাহলে হয়ত কখনো ভাইয়াকে আর দাফন করতে পারতাম না। আমরা ওদেরকে ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোনোমতে যেতে পারি নারায়ণগঞ্জ।
আর আমাদের দাফন করার টাইম ও মাত্র ৪০ মিনিট দেয়া হয়ছিল। আর দেখেন ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালায় তখন ও তাকে এই রকম সময়ই হাতে বেঁধে দেয়া হয়েছিল।
আমি আসলে জানি না যে দেশ আসলে এই শহীদের রক্তের ঋণ কখনো শোধ করেতে পারবে কিনা। আমার ভাই তো দেশের জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে জীবন দিয়েছিল, দেশের কথা ভেবে, দেশের মানুষের কথা ভেবে। ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বায়োতে লেখা ছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’
মানুষ কত দিন মনে রাখবে জানি না, কিন্তু আমাদের পরিবারের জন্য এই ক্ষত সরাজীবনের জন্য অপূরণীয়। আমি বলব আমার পরিবারই শুধু ভাইয়াকে হারায়নি এই পুরা জাতি একটা রত্নকে হারিয়ে ফেলল এই দেশ থেকে।