Image description

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যে তাঁদের মালিকানাধীন সম্পদ বিক্রি, বন্ধক বা হস্তান্তর করছেন। এই ব্যক্তিদের সম্পদের বিষয়ে যখন বাংলাদেশে তদন্ত চলছে, তখন এগুলো লেনদেন করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, গত বছর লেনদেনের এমন অন্তত ২০টি আবেদন জমা পড়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে।

গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার লন্ডনের প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার (১ পাউন্ড সমান ১৬৩ দশমিক ৩২ টাকা) সম্পদ জব্দ করে। এর তিন সপ্তাহ পর হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ জব্দ করা হয়। সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, হাসিনার শাসনামলে তিনি বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন—যার মধ্যে যুক্তরাজ্যেই রয়েছে ৩০০টির বেশি সম্পত্তি।

আমরা সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা সম্পর্কে অবগত। তাই আরও বেশি সম্পদ জব্দ করার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘লেনদেন বন্ধ করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলো আমাদের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পদ ফিরিয়ে আনার আশা জাগাবে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর

গার্ডিয়ান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানে দেখেছে, গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েকজন বাংলাদেশি তাঁদের যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ঢাকায় তদন্ত চলছে।

এই লেনদেনগুলো সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিরা লন্ডনে স্বাধীনভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শদাতা, যারা এই লেনদেনে সহায়তা করেছে, তাদের দায়িত্বশীলতা ও সতর্কতা প্রয়োগের ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় তদন্তাধীন ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সম্পত্তি সম্পর্কিত অন্তত ২০টি ‘লেনদেনের আবেদন’ গত এক বছরে জমা পড়েছে। এ ধরনের নথিপত্র সাধারণত বিক্রয়, হস্তান্তর বা বন্ধকের বিষয়টিই নির্দেশ করে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে ঢাকায় তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ব্যক্তিদের আরও বেশি যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি জব্দ করা হয়। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা সম্পর্কে অবগত। তাই আরও বেশি সম্পদ জব্দ করার বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘লেনদেন বন্ধ করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলো আমাদের সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পদ ফিরিয়ে আনার আশা জাগাবে।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় তদন্তাধীন ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সম্পত্তি সম্পর্কিত অন্তত ২০টি ‘লেনদেনের আবেদন’ গত এক বছরে জমা পড়েছে। এ ধরনের নথিপত্র সাধারণত বিক্রয়, হস্তান্তর বা বন্ধকের বিষয়টিই নির্দেশ করে।

এর মধ্যে তিনটি লেনদেনে বসুন্ধরা গ্রুপের কর্ণধার আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলমের পরিবারের সদস্যদের প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সমমূল্যের সম্পত্তি রয়েছে। এর একটি নাইটসব্রিজে অবস্থিত চারতলার একটি ‘টাউনহাউস’। এটি সম্প্রতি দুবার লেনদেন হয়েছে। এই লেনদেনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এটি সরাসরি বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের মালিকানাধীন ছিল।

আহমেদ আকবর সোবহানসহ তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।

যুক্তরাজ্যে জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুটি লেনদেনের আবেদন করেছে সোবহান পরিবারের আরেক সদস্যের মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারে অবস্থিত প্রায় ১৩০ কোটি টাকার সমমূল্যের একটি ম্যানসন।

এদিকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে দুদকের নজরে এসেছে আরও দুই ব্যক্তি। গত এক বছরে তাঁরা একাধিক সম্পত্তি লেনদেনে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের একজন হলেন সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান, অন্যজন সফল ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তাঁর নাম গার্ডিয়ান প্রকাশ করেনি।

এ বিষয়ে গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে বক্তব্য জানতে সোবহান পরিবারের একজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি। তবে এর আগে সোবহান পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সব অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এ অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে।

এদিকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিষয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে দুদকের নজরে এসেছে আরও দুই ব্যক্তি। গত এক বছরে তাঁরা একাধিক সম্পত্তি লেনদেনে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের একজন হলেন সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান, অন্যজন সফল ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তাঁর নাম গার্ডিয়ান প্রকাশ করেনি।

যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, আনিসুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন চারটি সম্পত্তিতে সম্প্রতি বাজারে তোলা হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল লন্ডনের রিজেন্টস পার্কের আশপাশের ১৬৩ কোটি টাকার সমমূল্যের জর্জিয়ান টাউনহাউস। এটি গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রি হয়। এর পর থেকে ‘লেনদেনের জন্য’ আরও তিনটি আবেদন করা হয়েছে।

আনিসুজ্জামান চৌধুরীর আইনজীবীরা জানান, তাঁর কোনো সম্পদ জব্দ করার জন্য বৈধ কোনো কারণ আছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। রিজেন্টস পার্কের সম্পত্তির বিক্রয়ের বিষয়টি ২০২৩ সালে চূড়ান্ত হয়েছিল।

মে মাসে এনসিএ ওই সম্পত্তিগুলো জব্দ করে, যার মধ্যে মেফেয়ারের গ্রোসভেনর স্কয়ারে অবস্থিত প্রায় ৫৭১ কোটি টাকার সমমূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান দুদককে অনুরোধ করেছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনভিত্তিক সেই ডেভেলপারকে ব্যাংক থেকে অনিয়মিতভাবে ঋণ পেতে সহায়তা করেছেন কি না, তা তদন্ত করার জন্য।

চলতি বছর বাংলাদেশের একটি আদালত ওই ডেভেলপারের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তিনি অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানে আরও তিনটি ‘লেনদেনের আবেদন’ জমা পড়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের (কারাবন্দী) ছেলে এবং ভাতিজার মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে। সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের বিষয়ে দুদকের তদন্ত চলছে।

মে মাসে এনসিএ ওই সম্পত্তিগুলো জব্দ করে, যার মধ্যে মেফেয়ারের গ্রোসভেনর স্কয়ারে অবস্থিত প্রায় ৫৭১ কোটি টাকার সমমূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।

ইতিহাস বলে যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সম্পদগুলো জব্দ না করলে তদন্ত চলার সময়ে সেগুলো দ্রুত হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে।
সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সভাপতি ব্রিটিশ এমপি জো পাওয়েল

সালমান এফ রহমান পরিবারের আইনজীবীরা বলেন, তাঁদের মক্কেলরা কোনো ভুল করেননি। বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক’ কারণে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁরা যুক্তরাজ্যে যেকোনো তদন্তে ‘সহযোগিতা করবেন’।

দুর্নীতি ও করবিষয়ক পর্যালোচনায় গঠিত সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সভাপতি ব্রিটিশ এমপি জো পাওয়েল চান এসব তদন্ত দ্রুত এগিয়ে যাক। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বলে যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সম্পদগুলো জব্দ না করলে তদন্ত চলার সময়ে সেগুলো দ্রুত হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে।’

এনসিএ ইতিমধ্যে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানান জো পাওয়েল। তবে তিনি যত দ্রুত সম্ভব এসব পদক্ষেপের আওতা আরও বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন।