Image description

শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গোলাম দস্তগীর গাজী সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বের আটটি দেশে তাঁর সম্পদ রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে গাজী, তাঁর স্ত্রী হাসিনা গাজী এবং সন্তান পাপ্পা গাজী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বিপুল টাকা খরচ করে। গাজী প্লাস্টিক (ইন্টারন্যাশনাল) নামে একটি ভুয়া কোম্পানি খুলে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন গাজী এবং তাঁর পরিবার।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাইয়ে গাজীর সম্পদ রয়েছে বলে দুদকের এক সূত্র জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দুদক তাঁর এসব অর্থ পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। প্রাথমিক হিসাবে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে ৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন গোলাম দস্তগীর গাজী।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গাজীর উত্থান পর্ব শুরু হয়।

এ সময় গাজী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আওয়ামী লীগের টিকিট পান। এমপিও হয়ে যান। কিন্তু এমপির পদ ব্যবহার করে গাজী জনকল্যাণ করেননি। লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজী হুন্ডি, আন্ডার ইনভয়েস এবং ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। গাজী প্লাস্টিক বিদেশে তাঁর প্লাস্টিকজাত পণ্য রপ্তানি করে বলে ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাজী প্লাস্টিকের পণ্য রপ্তানি শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গাজী প্লাস্টিক ৮২৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলাদেশে এসেছে মাত্র ২৩ কোটি টাকার পণ্য।

অর্থাৎ প্রায় ৮০০ কোটি টাকাই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। গাজী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ অর্থ অন্য দেশে স্থানান্তর করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্যের কাঁচামাল আমদানির নামে গাজী গত ১৫ বছরে প্রায় ৯২৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছেন। কিন্তু আমদানির যে প্রাক্কলিত মূল্য দেখানো হয়েছে, সে মূল্য বাজার মূল্যের প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গাজী ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা পাচার করেছেন। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে গাজী বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। যেমন মালয়েশিয়ায় যখন তাঁর সেকেন্ড হোম স্কিম কর্মসূচি চালু করেন, তখন গাজী এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্র তিনজনই এ কর্মসূচির আওতায় সেখানে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছিলেন। এ সেকেন্ড হোমের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ এটি বাংলাদেশ ব্যাংক বা গাজীর আয়কর নথিতে নেই। অর্থাৎ এ অর্থ অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বৈধ অনুমতি ছাড়াই সিঙ্গাপুরে তিনি গাজী প্লাস্টিকের নামে আন্তর্জাতিক কোম্পানি খুলেছেন। সেখানে গাজী প্লাস্টিকের পণ্য বিপণন করা হয়। বিভিন্ন সূত্র বলছেন, এটি অর্থ পাচারের কৌশল হিসেবে করা হয়। এ ছাড়া দুবাইতে গাজীর দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছেন। দুটি ফ্ল্যাটের মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। পাপ্পা গাজীর নামে যুক্তরাষ্ট্রের ল আইল্যান্ডে দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ বাড়িগুলো কীভাবে কেনা হয়েছে তা তদন্ত করছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছেন, এ তদন্তে যদি পাপ্পা গাজী যথাযথভাবে তাঁর আয়ের উৎস দেখাতে না পারেন, তাহলে তা জব্দ করা হবে।

কানাডার মন্ট্রিলে হাসিনা গাজীর নামে দুটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে এ ফ্ল্যাট দুটি কেনা হয়েছে। বর্তমানে ফ্ল্যাট দুটি ভাড়া রয়েছে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে গোলাম দস্তগীর গাজীর নিজের নামে সাড়ে ৪ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি অফিস স্পেস এবং একটি কুরিয়ার সার্ভিস রয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় গাজীর নামে একটি মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে।

প্রাথমিক হিসাব থেকে দেখা গেছে, গাজী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা গত ১৫ বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অথচ গাজীর যে আয়করের হিসাব দেখানো হয়েছে, তাতে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর যে মোট উপার্জন তার চেয়ে অনেক বেশি। গাজী এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন একাধিক মামলা করেছে। দুদকের নথি থেকে দেখা যায়, ১৫ বছরে গোলাম দস্তগীর গাজী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এর বিপরীতে তাঁর ব্যাংকঋণের পরিমাণ ৯৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এ ব্যাংকঋণের টাকাও গাজী কোথাও বিনিয়োগ করেননি। বরং পুরো টাকাই বিদেশে পাচার করেছেন। অন্যদিকে গোলাম দস্তগীর গাজীর সর্বশেষ অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বিদেশে তাঁর যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তার প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে তার আয়কর নথিতে দেখানো হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।

গাজী গত ১৫ বছরে ছয়টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এ ঋণগুলো এখন সবই খেলাপি। ঋণের টাকায় গাজী কোনো শিল্পকারখানাই করেননি। বরং ঋণের টাকা পুরোপুরি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। বিদেশে এসব পাচারকৃত অর্থ এখন তাঁর পরিবারের লোকজন দেখাশোনা করছেন। ২৫ আগস্ট গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার হন। কিন্তু তাঁর পুত্র এবং স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছেন, ৫ আগস্টের আগেই পাপ্পা গাজী বিদেশে পালিয়ে যান। প্রথমে তিনি দুবাইতে ছিলেন। এখন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে তিনি নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করছেন। ৫ আগস্টের পর পাপ্পা গাজী নভেম্বরে ‘গাজী এন্টারপ্রাইজ’ নামে মালয়েশিয়ায় নতুন আরেকটি এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে এক্সপোর্ট-ইমপোার্ট কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন রকম পণ্য মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুরেও এর শাখা খোলা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র বলছেন, এ দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে এখন পাপ্পা গাজী নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশন ইতোমধ্যে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে চিঠি দিয়েছে। অর্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন তৎপরতা নিয়েছে। কিন্তু এসব অর্থ পাচারের তৎপরতায় গোলাম দস্তগীর গাজীর নাম কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাঁর বিদেশের সম্পদ পাচারের বিষয়টি এখনো অধরাই রয়ে গেছে। 

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে গাজী যে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন তা এখন সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। কারণ তিনি যে পরিমাণ রপ্তানি দেখিয়েছেন, সে পরিমাণ টাকা বিদেশ থেকে আসেনি। একই সঙ্গে তিনি যত টাকার কাঁচামাল আমদানি করবেন বলে দেখিয়েছেন সে টাকার কাঁচামাল আসেনি। সুস্পষ্টভাবে এটি মানি লন্ডারিং আইনে দ নীয় অপরাধ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। 

বিভিন্ন সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে সিআইডিকে এ বিষয়ে একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিআইডি এ বিষয়টি তদন্ত করছে। গাজীর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, শুধু এ কয়েকটি দেশেই নয়, আরও বিভিন্ন দেশে গাজীর বিপুল পরিমাণ পাচারকৃত অর্থ রয়েছে। এসব অর্থ উদ্ধারের জন্য দ্রুত একটি টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন।

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।