Image description
বিবিএস জরিপ ও দুদকের প্রতিবেদন

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনে ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। দুদক গত ১১ মাসে যেসব দুর্নীতির মামলা করেছে; সেখানে আসামির তালিকায় সরকারি চাকরিজীবীরাই শীর্ষে। দুদকের পর এবার সরকারি অন্য সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) জরিপে উঠে এসেছে প্রায় একই ধরনের তথ্য। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেবা দেওয়ার বিনিময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ ঘুষ নিচ্ছেন। আর এ ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় ৩৩ শতাংশ সরাসরি ঘুষ নেন; তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ আদায়কারীর শতকরা হারও প্রায় সমান। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বা পরোক্ষভাবে ঘুষ নেন ঘুষখোরদের ২১ শতাংশ। সরাসরি ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা শহরের তুলনায় গ্রাম বা মফস্বলে কর্মরতদের মধ্যে বেশি। ঘুষখোররা ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা নেন প্রায় ৯৮ শতাংশ। টাকা ছাড়াও ভ্রমণের টিকিট, মূল্যবান উপহার সামগ্রী এমনকি খাদ্য পানীয় নেওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়।

বিবিএস পরিচালিত ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে’ বা নাগরিক অভিমত শীর্ষক জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে সরকারি সেবা নিতে গত এক বছরে দেশের নাগরিকরা ঘুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন কি না, জানতে চাওয়া হয়। গত জুন মাসে যার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ জরিপ চালানো হয়। ওই প্রতিবেদনে কীভাবে ঘুষ দাবি করা হয়, সে তথ্যও উঠে এসেছে। জরিপের জন্য ৬৪ জেলার ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসএল) থেকে ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ নারী-পুরুষ উত্তরদাতার সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যবিষয়ক এসডিজি-১৬ এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি বিষয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। জরিপের প্রশ্নপত্র জাতিসংঘের নির্ধারিত। এ জরিপ থেকে এসডিজি-১৬ এর ৬ সূচকের তথ্য পাওয়া গেছে। বিবিএসের জরিপে সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দেওয়ার বিষয়ে দেশের নাগরিকদের মতামতও উঠে এসেছে।

বিবিএস বলছে, জরিপের এ অধ্যায়ে গত ১২ মাসে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে কমপক্ষে একবার ঘুষ দিয়েছেন অথবা একজন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক ঘুষ চাওয়া হয়েছে—এমন ব্যক্তিদের শতাংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, একই সময়ের মধ্যে একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কমপক্ষে একবার যোগাযোগ করেছেন—এমন ব্যক্তিদের শতাংশও হিসাব করা হয়েছে।

এর আগে দুদকের এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট থেকে গত ১১ মাসে দুদক মোট ৩৯৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় মোট ১ হাজার ২৬৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার ২৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দুর্নীতির ১৫৩টি মামলায় ৪৭৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তা। অথচ ২০২৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছিলেন মাত্র ১২০ জন।

দুদক বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঘুষ ছাড়া অনেক সরকারি দপ্তরে সেবা পাওয়া যেত না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপ অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মানুষ ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ১ দশমিক ৪৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে দুদকের অভিযান জোরদার হয়। গত ১১ মাসে দুদক যে ৩৯৯টি মামলা করেছে, সেখানে আসামির তালিকায় শেখ হাসিনা, তার পরিবার, প্রাক্তন মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেনা ও পুলিশ সদস্যরাও রয়েছেন।

দুদকের প্রতিবেদনের সত্যতা মিলেছে বিবিএসের জরিপ থেকে। বিবিএস বলছে, সরাসরি চাওয়ার তুলনায় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সরকারি কর্মকর্তারা। অর্থাৎ, তারা নিজেরা সরাসরি ঘুষ না চেয়ে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সেবার বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন। জরিপে নাগরিকদের দেওয়া তথ্য বলছে, ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ ঘুষখোর কর্মচারী সরকারি সেবার বিনিময়ে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নিয়েছেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঘুষ নিয়েছেন ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঘুষ চাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শহরের ২৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঘুষখোর কর্মচারী সরাসরি ঘুষ চান, সেখানে মফস্বলে সরকারি সেবার বিনিময়ে ৩৪ দশমিক ৭০ শতাংশ ঘুষখোর কর্মচারী সরাসরি ঘুষ দাবি করেন। অর্থাৎ, সরাসরি ঘুষ চাওয়ার প্রবণতা শহরের তুলনায় গ্রামের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশি।

সরাসরি না চেয়ে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ দাবি করার প্রবণতা শহরের ঘুষখোরদের মধ্যে বেশি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শহরের ঘুষখোরদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নিয়েছেন। আর গ্রামের ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ কর্মকর্তা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে ঘুষ নেন। অন্যদিকে, যেখানে গ্রামের ২০ দশমিক ৯৩ শতাংশ কর্মকর্তা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঘুষ দাবি করেন, সেখানে শহরের ২৩ দশমিক ১৯ শতাংশ কর্মকর্তা ঘুরিয়ে- পেঁচিয়ে ঘুষ দাবি করেন।

জরিপের তথ্যানুসারে, সবচেয়ে বেশি ঘুষ-দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, এক বছরে বিআরটিএতে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হন। এ হার আইনপ্রয়োগকারীর সংস্থায় ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, পাসপোর্ট অফিসে ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ভূমি নিবন্ধন অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ছাড়া কর্মচারীরা ঘুষ না চাইলেও সেবাগ্রহীতাদের মধ্যেও স্বেচ্ছায় ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা দ্রুত সেবা পেতে ঘুষ দিয়ে থাকেন বলে বিবিএসের জরিপে মতামত দিয়েছেন। এ হিসাবটাও কম নয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ নাগরিক সরকারি সেবা পেতে স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন। স্বেচ্ছায় ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা গ্রামের থেকে শহরে বেশি। যেখানে গ্রামের ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ নাগরিক স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন, সেখানে শহের এ হার ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে, অনেকে আবার সেবা পাওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সরকারি চাকরিজীবীদের ঘুষ দিয়ে থাকেন। বিবিএসের জরিপে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন, তাদের কাছে কেউ ঘুষ চাননি, এটাকে তারা কাজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হিসেবে মতামত দিয়েছেন।

জরিপে আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে সেটা হলো, সরকারি চাকরিজীবীরা ঘুষ হিসেবে কী কী স্থাবর-অস্থাবর, দ্রব্যাদি নিয়ে থাকেন। জরিপের তথ্য বলছে, ঘুষখোররা ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা নেন। পাশাপাশি খাদ্য বা পানীয়, মূল্যবান পণ্য অথবা অন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা নেন। যেমন ভ্রমণের জন্য টিকিট, হোটেল ভাড়া অথবা অন্য কোনো সুবিধা। জমি বা ফ্ল্যাট নেওয়ার রেকর্ডও আছে দুদকের নথিতে। বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, সেবা দেওয়ার বিনিময়ে ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ ঘুষখোর টাকা নিয়ে থাকেন। ৪ দশমিক ১৪ দশমিক ঘুষখোর খাদ্য বা পানীয় কিছু নেন। এক শতাংশ সরকারি চাকরিজীবী অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নেন।

জরিপের ফল সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিজেন পারসেপশন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) রাশেদ-ই মাসতাহাব কালবেলাকে বলেন, ‘নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচার সম্পর্কে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা জানার জন্য জরিপটি করা হয়। এতে অন্যান্য বিষয়ের মতো সরকারি সেবা নিতে ঘুষের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের মতামত উঠে এসেছে। ঘুষের বিষয়ে সেবাগ্রহীতারা যে তথ্য দিয়েছেন তাই শুধু আমরা জরিপে তুলে ধরা হয়েছে।’

সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ ও দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থা দুদক। বাংলাদেশে সাধারণত দুদকই সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতির তদন্ত করে। কিছু কিছু তদন্ত পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা বা সিআইডিও করে থাকে। ঘুষখোর সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘আইনের আওতায় আনতে সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধের বিষয়টিকে কমিশন সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়। কারণ, দুর্নীতির মামলাগুলোর অধিকাংশ অভিযুক্তই তারা (সরকারি চাকরিজীবী)। আর দুদকে যেসব অভিযোগ জমা হয় সেগুলোও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেই বেশি।’

দুদকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দুদক মোট ৭৬৮টি অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তের জন্য গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৩৯৯টি মামলা দায়ের, ২৩১টি অভিযোগপত্র দাখিল ও ৯টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিশন ২২৩টি সম্পদ বিবরণী জমার নোটিশও দিয়েছে। ড. মোমেন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বছরের জানুয়ারিতে একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ ৭০টি মামলা হয়েছে। গত ১১ মাসে দুদকের মামলায় মোট ১ হাজার ২৬৪ জন আসামির মধ্যে ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১১৪ জন ব্যবসায়ী, ৯২ জন রাজনীতিবিদ, ৪৪৭ জন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং ৩১ জন জনপ্রতিনিধি। মামলাগুলোর মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, বৃহৎ সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ ও বৈধ আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারে কারচুপি ও অবৈধভাবে জমি দখল, ঘুষ হিসেবে জমি ও ফ্ল্যাট নেওয়ার তথ্য আছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও কানাডায় বাড়ি ক্রয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার অভিযোগও রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আছে।

এ ছাড়া গত ১১ মাসে দুদকে মোট ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে শুধু গত বছরের নভেম্বরে জমা পড়েছে ৩ হাজার ৪০৬টি। দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তর ও অন্যান্য দপ্তর থেকে পাওয়া প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি অভিযোগ নিয়েও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সেবার নামে ঘুষ নেওয়া নাগরিকদের সঙ্গে বঞ্চনা বা এক ধরনের প্রতারো। সেবার বিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া বা বিভিন্নভাবে খুশি করার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত। এটাকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রের তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও সেটার বাস্তবায়ন দেখা যায়। ফলে ঘুষ নেওয়ার মতো নিয়মতান্ত্রিক অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না, বরং বেড়েই চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দেওয়া বা সেবাদাতাকে খুশি করার মতো পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এ ধারণাটা এখন প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ, সেবাগ্রহীতারা এ ধারণা বিশ্বাস করেন যে, অর্থ খরচ না করলে বা সংশ্লিষ্টদের খুশি না করলে সেবা পাওয়া যাবে না অথবা সেবা পেতে বিলম্ব হবে। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ, যারা ঘুষ নেন তারা এমন কৌশল অবলম্বন করেন, যাতে অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। মাঝেমধ্যে দু-একজন ধরা পড়েন।’

তিনি আরও বলেন, একটি স্বাধীন দেশে সরকারি সেবা পাওয়া নাগরিকের অধিকার। অথচ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে আবার অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হচ্ছে, এভাবে সেবার নামে অর্থ আদায় নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক ধরনের বঞ্চনা বা প্রতারণা এবং রাষ্ট্র এটা দীর্ঘদিন ধরে মেনে নিচ্ছে। এ ধরনের নিয়মতান্ত্রিক অনিয়ম বন্ধে সরকারের আরও কঠোর হওয়া দরকার, শুধু মুখে মুখে ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললে হবে না, এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন—এ তিনটি বিষয় লাগবেই; কিন্তু এ তিন সূচকের কোনোটাই বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে নেই। ফলে সেবা দেওয়ার নামে ঘুষের অপসংস্কৃতি একটি দৈনন্দিন চর্চায় পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এ অপসংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়।’