Image description

মেয়েটা বেঁচে থাকলে এ বছর এসএসসি পাশ করত। এ বছর যখন এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হয়, তখন যেন আর একবার নাঈমার পরিবারে নাঈমাকে নিয়ে কষ্ট বেড়ে যায়—মা আইনুন নাহার বলেন, এমন অনেক দিন আসে নাঈমার জন্য কষ্ট আরো দগদগে হয়ে ওঠে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রথম শহিদ নারী নাঈমা সুলতানা (১৫)। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকনো কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিত্সক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা মেজো। পড়াশোনায় ভালো বলে মা সন্তানদের নিয়ে ঢাকা থাকতেন, আর বাবা বাড়িতে। নাঈমা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত। ২৫ জুলাই তার ১৫তম জন্মবার্ষিকী। মা বলেন, ‘ও বড় কিছু করতে চাইত। ওর মেধা ছিল, চেতনা ছিল। কোটা আন্দোলনে বাইরে যেতে না পারলে ঘরে বসে আঁকত প্রতিবাদী ছবি, লেখা। কিন্তু ঘরের ভেতরেও ও নিরাপদ ছিল না।’

একটা বছর কেটে গেছে। নাঈমার মা স্বাভাবিক হতে পারেননি আজও। সময়ের ধারায় কমেনি ক্ষত, শুকায়নি কান্না। এখন পর্যন্ত সরকার মোট ৮৪৪ জন শহিদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৬০ বছর বয়সি ১১ জন নারীর নাম রয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের করা পৃথক তালিকাতেও ১০ জনের নাম শহিদ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। ১০ জনের মধ্যে চার জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ হওয়া নারীরা হলেন নাঈমা সুলতানা (১৫), মায়া ইসলাম (৬০), শাহিনুর বেগম (৫৫), নাছিমা আক্তার (২৪), মেহেরুন নেছা (২২), লিজা আক্তার (২১), সুমাইয়া আক্তার (২০), নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭), রিতা আক্তার (১৭) ও রিয়া গোপ (৬)। তাদের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষার্থী, দুজন কর্মজীবী, দুজন গৃহবধূ। একজনের শিক্ষা বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ছিল না।

এই পরিবারগুলো আজও থমকে আছে সেই এক মুহূর্তে, যেখানে শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিয়েছিল তাদের সন্তান, তাদের মেয়ে, মা।

এখন আর জীবনের মানে খুঁজে পাই না

১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন মায়া ইসলাম, রিয়া গোপ, নাছিমা আক্তার। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকালে রিয়া গোপ নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়ির ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়। ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ ছাদে খেলছিল। বাইরে তখন থেমে থেমে গুলির শব্দ, আতঙ্কে মেয়েকে আনতে ছাদে যান বাবা দীপক গোপ। কোলে নিতেই গুলিটি মাথায় বিঁধে। কয়েক সেকেন্ডেই বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ে রিয়া। চার দিন ঢাকা মেডিক্যালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর ২৪ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে। এক বছর পরেও রিয়ার মা বিউটি ঘোষ স্বাভাবিক হতে পারেননি। বাবা দীপক বলেন, ‘রিয়া ছাড়া একটা মুহূর্তও কাটত না। সেই রিয়াই নেই। কথা বলতেও ভালো লাগে না। আসলে এখন আর জীবনের মানে খুঁজে পাই না।’ রিয়াকে হারানোর পর প্রথম দিকে কিছু অনুদান মিলেছিল। কিন্তু সন্তানের শূন্যতা তো কোনো অনুদানেই পূরণ হওয়ার নয়।

চিটাগাং রোডের বাসায় বিকালটা কাটাচ্ছিলেন ২০ বছরের সুমাইয়া আক্তার, কোলে আড়াই মাসের শিশু। আন্দোলনের হট্টগোলে জানালা দিয়ে তাকাতে গিয়েছিলেন। আর তখনই একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার মাথায়। মুহূর্তেই পড়ে যান বারান্দায়। সুমাইয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় কেউ সাহায্য করতে চায়নি, কেউ গাড়ি দেয়নি, কেউ রাস্তায় যেতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সক জানান, সুমাইয়া আর নেই। মৃত্যুর পর স্বামী কোনো খোঁজ রাখেন না। তার আড়াই মাসের সন্তন এখন নানির কোলে বড় হচ্ছে। ছোট্ট শিশুটি মা শব্দটি শিখবে কি না, জানে না কেউ।

নাফিজার জন্যই মা কুয়েত যান

টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া ছিলেন সাহসী নেতৃত্বের প্রতীক। ১৭ বছরের এই কিশোরী ফেসবুক-মেসেঞ্জারে বন্ধুদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত রাজপথে নামতেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে। বাবা একজন চা দোকানদার, মা কুয়েতে। মা কুয়েত থেকে ফোনে বলেন, ‘মেয়ের জন্যই দেশের বাইরে আসি। ওর স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করবে। মামাদের বাসায় থেকেই আন্দোলনে যেতেন নাফিসা। বাবা একবার প্রতিবেশীর কাছে শুনে তাকে বকাঝকা করেন। এরপর ২৮ জুলাই সাভারে মামার বাসায় যান তিনি। ৫ আগস্ট সকালে মামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লংমার্চে যোগ দেন নাফিসা। দুপুর আড়াইটায় বাবাকে কল দিয়ে বলেন, ‘আব্বু, হাসিনা পলাইছে।’ বাবা রাগি কণ্ঠে বলেন, ‘তোর কিছু হইলে কে দেখবে’। পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যৌথ হামলায় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন নাফিসা। সহপাঠীরা তাকে নিয়ে যান হাসপাতালে, সেখান থেকে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

প্রতিটি মৃত্যু এক একটি অসমাপ্ত গল্প

২২ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টা। ৫৭ বছরের শাহিনুর বেগম ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বেরিয়েছিলেন হাঁটতে। কাজলা সেতুর দিক দিয়ে হাঁটছিলেন আরো দুই-তিন জন নারীর সঙ্গে। হঠাত্ সেখানেই শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ। শাহিনুর গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিলেন তিনি। সকাল ১০টার দিকে এক অচেনা ব্যক্তি তাকে ভ্যানগাড়িতে করে শনির আখড়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যালে। হাসপাতালে পৌঁছে চিকিত্সকেরা জানান, অপারেশন জরুরি, তবে স্বজন ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত তার কাছে পাওয়া একটা পুরোনো বাটন ফোন থেকে একটি নম্বরে কল করে মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসেন শাহিনুরের মেয়ে। শাহিনুরকে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য তিন দিন চেষ্টা করে তবেই ব্যবস্থা মেলে। তার আগেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেয়ে বলেন- ‘এক মাস নয় দিন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একটা শব্দ শোনার আশায়। কিন্তু কোনো জবাব পাইনি, শুধু পা আর হাত নড়েছে।’ শাহিনুর ছিলেন পাঁচ সন্তানের মা। স্বামী প্যারালাইজড। শাহিনুর সংসার চালাতেন মাছ বিক্রি করে। তার মৃত্যু শুধু পরিবারের আয় বন্ধ করেনি, এক মাসের মধ্যে তাদের শহর ছেড়ে কুমিল্লা চলে যেতেও বাধ্য করেছে।

বারান্দায় গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন গৃহকর্মী লিজা

শান্তিনগরের ১৪ তলা ভবনের নবম তলায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন ১৮ বছরের মোসাম্মত লিজা। পাশাপাশি পড়তেন পাশের মহিলা মাদ্রাসায়। ভোলার দেউলা শিবপুর থেকে বড় ভাই রাকিবের হাত ধরে ঢাকায় এসেছিলেন বছর ছয় আগে। ১৮ জুলাই বিকালে বাইরে চিত্কার ও গুলির শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান লিজা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। ২২ জুলাই পপুলার হাসপাতালে মারা যান তিনি।

ভাইয়ের ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ হারালেন নাছিমা

২৪ বছরের নাছিমা আক্তার ছিলেন নোয়াখালীর মাইজদীর মেয়ে। ঢাকার ধানমন্ডিতে বড় ভাইয়ের বাসায় এসেছিলেন বেড়াতে। ১৯ জুলাই দুপুরে দুই ভাতিজা ছাদে ওঠে পরিস্থিতি দেখতে। পেছন পেছন ছুটে যান নাছিমাও। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাত্ গুলি লাগে বড় ভাতিজার গায়ে, একই গুলি বিদ্ধ করে নাছিমাকেও। গুলি তার গলা ভেদ করে খাদ্যনালিতে গিয়ে লাগে। দুই জনকেই তড়িঘড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় পপুলার হাসপাতালে। ছেলে বেঁচে ফিরে আসে, কিন্তু নাছিমা চলে যান না ফেরার দেশে।

১৭ বছরের রিতা আক্তার ছিলেন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের তালখুর গ্রামের মেয়ে। তার বাবা রিকশাচালক, মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। ভালো ফলাফলের কারণে পরিবারের আশা হয়ে উঠেছিলেন রিতা। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। ঢাকায় এসে মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। মা-বাবা মিরপুর-২ এলাকায় কম ভাড়ার ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য। কিন্তু ৫ আগস্ট, সকালে বাবা-মা কাজে গেলে, রিতা বাসা থেকে বের হন ‘মার্চ-টু-ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার আর খোঁজ মেলেনি। রাত ১০টার পর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যালের মর্গে তার মৃতদেহ খুঁজে পান মা। মাথার এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

নাতিকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন দাদি মায়া ইসলাম

৬০ বছর বয়সি মায়া ইসলাম ১৯ জুলাই দুপুরে রাস্তায় যান নাতিকে আইসিক্রম কিনে দিতে। বনশ্রী এলাকার ভাড়া বাসা থেকে বেরিয়ে গেটের সামনেই পড়েন সংঘর্ষের মুখে। পুলিশের গুলি সাত বছরের নাতি মুসার মাথায় বিদ্ধ হওয়ার পর একই গুলি ভেদ করে মায়ার তলপেট। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুইতলায় ওঠার চেষ্টা করলেও সিঁড়িতেই অচেতন হয়ে পড়েন মায়া। হাসপাতালে নেওয়ার পর সেদিন বেচেঁ গেলেও পরদিন ঢাকা মেডিক্যালে মারা যান তিনি।

আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না”- মেহেরুন নেছা তানহার দৃঢ়তা

২২ বছর বয়সি মেহেরুন নেছা তানহা হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। শুরুতে আন্দোলনে সক্রিয় না থাকলেও ১৯ জুলাই মামাতো ভাই রাব্বির মৃত্যুর পর তার রক্তের বিচার চেয়ে রাজপথে নামেন। ৫ আগস্ট, প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার খবরে আনন্দমিছিল শেষে বাসায় ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেহেরুন। নিরাপদে বাসায় ঢুকে ছোট ভাইকে ফোন করে সতর্কও করেছিলেন, কিন্তু জানালার পাশে দাঁড়াতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন।

বিচার চান সবাই, চান স্বীকৃতি

শহিদ ১০ জন নারীর মধ্যে সাত জন ঢাকায়, দুই জন নারায়ণগঞ্জে ও এক জন সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সাত জনই গুলিবিদ্ধ হন নিজ বাসার বারান্দা ও ছাদে। তিন জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সড়কে। নাফিসা হোসেন মারওয়ার মা কুলসুম কান্নায় ভেঙে পড়ে বিচার দাবি করেন তার মেয়ের হত্যার। নাঈমার মা আইনুন নাহার বলেন, আমি বিচার চাই। দোয়া করি আর কোনো দিন যেন দেশে জুলাই না আসে। কোনো মায়ের বুকখালি না হয়। শহিদ পরিবারগুলো জুলাইয়ের সনদ দাবি করেন, চান তাদের আপনজনের অবদানের স্বীকৃতি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও নারী পক্ষের সদস্য শিরীন পারভিন হক বলেন, দুটি দাবিই আমাদের ছিল একটি বিচার এবং অন্যটি স্বীকৃতি প্রদান। তিনি মনে করেন তাদের স্বীকৃতি দেওয়া খুব কঠিন কিছু না, কারণ যেখানেই কেউ মারা গেছেন, সেই এলাকার সবাই জানেন কে বা কারা মারা গেছেন। কিন্তু তারপরও ১৯৭১-এর মতো ২০২৪-এও আমরা শহিদদের তালিকা করা ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অনেক দেরি করে ফেলছি।